মোহামেডানের সদস্য কেলেঙ্কারি!

ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির পর এবার সদস্য বানানোর নামে অর্থ আত্মসাতের মতো প্রতারণার তথ্য বেরিয়ে এলো দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিরুদ্ধে। ২১৩ জনের বাইরে আরও ১১১ জনের কাছ থেকে স্থায়ী সদস্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মোহামেডানেরই প্রভাবশালী একটি চক্র। অর্থ খরচা করলেও মোহামেডানের স্থায়ী সদস্যের তালিকায় নেই তাদের নাম। সম্প্রতি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেসি) থেকে পাওয়া তালিকায় এমন চিত্রই পাওয়া গেছে।

সূত্রে জানা গেছে, বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) অনুমোদন ছাড়াই ১১১ জনকে স্থায়ী সদস্য করা হয়েছিল। এদের মধ্যে আমেরিকায় পালিয়ে যাওয়া এক ক্রীড়া সাংবাদিক রয়েছেন। যার স্বামী আমেরিকার বিভিন্ন টেলিভিশনে বর্তমান সরকারের বিষোদ্গার করে প্রায়শই বক্তব্য দেন। কিন্তু এদের নাম জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে লিপিবদ্ধ নেই। ঢাকা মোহামেডানের ২১৩ জনের অনুমোদন রয়েছে আরজেসিতে। স্থায়ী সদস্য পদ দেয়ার নামে প্রত্যেকের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা করে পে-অর্ডার নেয়া হয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, অনেকের কাছ থেকে পে-অর্ডারের বাইরেও কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ক্লাবের প্রভাবশালী চক্রটি। গত ১৬ অক্টোবর আরজেসির সত্যায়িত করা তালিকায় মোহামেডানের স্থায়ী সদস্য হিসেবে ২১৩ জনের নাম রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, মোহামেডানের প্রবাদপুরুষ মনিরুল হক চৌধুরীকে ক্লাবের স্থায়ী সদস্য করা হয়নি।

নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির মধ্যে আকণ্ঠ নিমজ্জিত দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি। দেড় যুগ ধরে তেমন কোনো সাফল্য নেই। অথচ আকাশছোঁয়া ভবন নির্মাণের স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে প্রতি বছরই। অথচ ভবন দূরে থাক, ইটের গাঁথুনিও শুরু হয়নি। দু’বছর মেয়াদি কমিটির আট বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। তবু হচ্ছে না নির্বাচন। নানা রকম টালবাহানা করে সময় পার করেছে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব লিমিটেডের বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ। ২০১১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর মোহামেডান ক্লাবের পরিচালনা পর্ষদের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোহামেডান অন্তঃপ্রাণ সংগঠকদের অধিকাংশই ওই নির্বাচন বয়কট করেছিলেন। ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির ১৪ জন একতরফা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তিনটি পদ শূন্য থাকে। পরবর্তীতে শূন্য তিন পদ লোকদেখানো নির্বাচনের মাধ্যমে পূরণ করা হয়।

লিমিটেড কোম্পানির বিধিবিধান অনুযায়ী কমিটির দু’বছরের মেয়াদকাল শেষ হয় ২০১৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। মেয়াদ শেষ হলেও নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হয় পরিচালনা পর্ষদ। আরজেসি’র দ্বারস্থ হয় মোহামেডান। আরজেসি ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন আয়োজনের সময়সীমা বেঁধে দেয়। ওই সময়সীমাও পার হয়ে যায়। তারপর নির্বাচন আয়োজনের জন্য মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনা চাওয়া হয়। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী দ্বিতীয় ও তৃতীয় বার্ষিক সাধারণ সভা করে চলতি বছর এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ২০১৫ সালের ১৪ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী, রায় প্রকাশের এক মাসের মধ্যে নির্বাচন করার কথা। কিন্তু হাইকোর্টের নির্দেশনারও বাস্তবায়ন হয়নি। পরবর্তীতে আবারও কোম্পানি আইনে নির্বাচন আয়োজনের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা চাওয়া হয়।

গত ২৮ আগস্ট হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিনিয়র অ্যাডভোকেট এএম আমিন উদ্দিনকে মোহামেডানের অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতির দায়িত্ব দেন। তার মূল দায়িত্বই হচ্ছে, নির্বাচনের আয়োজন করা। এরই মধ্যে ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করেছে মোহামেডানের মেম্বার ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়াকে। ১৯৯৪ থেকে ২০১৯- এই ২৫ বছর ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক ছিলেন র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। দীর্ঘ ১৭ বছর সাধারণ সম্পাদক এবং আট বছর ডাইরেক্টর ইনচার্জের পদ দখল করে রীতিমতো ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে গেছেন তিনি। খেলাধুলার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও বিএনপি নেতা মোসাদ্দেক আলী ফালুর হাত ধরে মোহামেডান ক্লাবে প্রবেশ লোকমানের। এরপর থেকে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাবেক এই ক্যাডারকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

অন্যদিকে বহুতল ভবন নির্মাণের কথা বলে প্রতি বছরই বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বর্তমান পরিচালনা পরিষদ। ২০১৫ সালের ২৮ জুন ক্লাবের প্রয়াত স্থায়ী সদস্য আমিনুল হক মনির স্মরণ অনুষ্ঠানে ৫২তলা ভবন নির্মাণের ভিজ্যুয়াল নকশা দেখানো হয়। এর আগেও কয়েক দফা ভবনের নকশা দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই সার। মোহামেডান ক্লাবের এক স্থায়ী সদস্য বলেন, ‘ভবন তৈরির নামে প্রতি বছর একটি করে অনুষ্ঠান করা হয়। কিন্তু ভবন আর নির্মিত হয় না। পুরোটাই একটা ধাপ্পাবাজি বলেই মনে হচ্ছে।’ এর আগে মোহামেডানের আর্থিক হিসাব বিবরণীতে ব্যাপক গোঁজামিল ও দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া গিয়েছিল।

২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট মোহামেডান সভাপতির কাছে হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং. অডিট ফার্মের দায়ের করা ১৭ পৃষ্ঠার রিপোর্টে (সূত্র হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং./ জেআর/রিভিউ/এমএসসিএল /২০১৩/১৩৭৯) অনিয়মের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অডিট ফার্মটি ২০১১ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এক বছরের হিসাব বিবরণী পর্যালোচনা করে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা দেয়। ওই রিপোর্ট নিয়ে মোহামেডান ক্লাবের সাধারণ সভায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই তদন্ত কমিটি অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে কয়েক দফা বৈঠক করে ক্লাবে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র উদ্ঘাটন করে। তদন্ত কমিটির সেই রিপোর্ট আজও আলোর মুখ দেখেনি। বছরের পর বছর লুটপাট ও কুক্ষিগত করে রাখার কারণে ক্লাবমুখো হন না ত্যাগী ও পুরনো ক্রীড়া সংগঠকরা।

এখানে খেলার চেয়ে ব্যবসা চলে বেশি। ক্লাবকে ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন অনেকেই। ‘মোহামেডান ক্লাবের ঐতিহ্য ও ইতিহাস আজ ভূলুণ্ঠিত হওয়ার উপক্রম। দেশের কোটি কোটি সমর্থকের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক মোহামেডানকে ঘিরে চলছে অশুভ তৎপরতা’, কথাগুলো বলেছিলেন মোহামেডানের আজীবন সদস্য ও বর্ষীয়ান ক্রীড়া সংগঠক মনিরুল হক চৌধুরী।

তিনি যোগ করেন, ‘এ দেশে মোহামেডান ক্লাবের জন্ম হয়েছিল একটি বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। যুগ যুগ ধরে ক্লাবের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হয়েছে। বিভিন্ন সময় ত্যাগী ক্রীড়া সংগঠকরা এই ক্লাবের হাল ধরেছেন। মইনুল ইসলাম, কর্নেল মালেক ও শফিকুল গনি স্বপনদের অবদান আজ স্বীকার করা হয় না। ওনাদের মৃত্যুবার্ষিকীতে কোনো মিলাদ হয় না ক্লাবে।’ মোহামেডানের এই প্রাণপুরুষ বলেন, ‘সরকার এই ক্লাবকে সাড়ে পাঁচ বিঘা জমি দিয়েছে ক্রীড়া সামাজিক ও সংস্কৃতির কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য। অথচ সেই ক্লাবটিকে বিক্রি করে ফায়দা লুটছে লোকমান হোসেন ভূঁইয়া। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি টেনেহিঁচড়ে নামানোর নেতৃত্ব দেয়া লোকমান পরবর্তীতে মোহামেডানের সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিলেন। কখনও বিএনপি, কখনও আওয়ামী লীগের লেবাস লাগিয়ে ক্লাব লুটেপুটে খাচ্ছিল এই চক্রটি।’

খবর সারাবেলা/২০/ অক্টোবর ২০১৯ /এসএম