অন্তত একবেলা একসঙ্গে খান

দুপুরে গোসলের পর আর রাতে খাবার টেবিলে সবার হাজির হওয়াটা ছিল অনন্যাদের বাড়ির নিয়ম। বাসার ছোট যে সদস্য, সে বছর পাঁচেক বয়স পর্যন্ত খেতো বাবার থালায়। একেক পদ দিয়ে ভাত মেখে থালার একপাশে আলাদা করে রেখে দিতেন বাবা। এভাবেই তারা সব ভাইবোন সব ধরনের খাবার খেতে শিখেছে।

খাবার টেবিলটাই ছিল তাদের পরিবারের মূলমঞ্চ। খাবারের পাশাপাশি সেখানে চলতো সারা দিনের গল্প। সারা দিন কে কী করলো, তার বয়ান থেকে শুরু করে জরুরি কোনো আলোচনা, সিদ্ধান্ত ইত্যাদি এই টেবিল থেকেই জেনে যেতো সবাই। অনেক সময় দেখা যেতো, খাওয়া শেষ, হাত শুকিয়ে গেছে কিন্তু গল্প শেষ হচ্ছে না। এভাবেই বড় হয়েছে অনন্যারা।

অনন্যার নিজেরই এখন সংসার হয়েছে। সন্তানও আছে। কিন্তু অনন্যার ছোটোবেলা আর তার সন্তানের ছোটবেলার মধ্যে কত ফারাক! অনন্যা আর তার স্বামী দুজনই চাকরিজীবী। দিনের একটা লম্বা সময় বাইরে থাকতে হয় তাদের। সন্তান থাকে গৃহকর্মীর কাছে। চাইলেও অনন্যার এখন আর সবাইকে নিয়ে একসাথে খাওয়া হয় না। আর এই চিত্র এখন অধিকাংশ পরিবারের।

চিকিৎসক ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, এর ফলে নানা শারীরিক ও মানসিক জটিলতা তৈরি হচ্ছে। যেমনটা হয়েছে অনন্যারও। ৩০ বছর বয়স পর্যন্ত তাকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়েছে খুব কম। কিন্তু এখন প্রায়ই যেতে হয় বদ্যিবাড়ি। যেতে হয় ছয় বছরের ছেলেকে নিয়েও। এরই মধ্যে ছেলের চোখে চশমাও লেগেছে। চিকিৎসকদের একটাই কথা, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতে হবে।

বাড়িতে একসঙ্গে খাওয়ার প্রবণতা বর্তমানের ছেলে মেয়েদের মধ্যে নেই বললেই চলে। এর কারণ হতে পারে তাদের বাইরে থাকা। সারাদিন শেষে রাতে বাসায় ফিরেও থাকে যে যার মতো। খাবার টেবিলে বসে খাওয়া যেনো সবথেকে অপছন্দের একটা কাজ তাদের কাছে। খাবার নিয়ে চলে যায় টিভি, ল্যাপটপ বা মোবাইলের কাছে। খাবার পছন্দ না হলে অর্ডার করে এনে খায়। আর এতে করে দূরত্ব বাড়ে সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের।

এ তো গেলো বাংলাদেশের এখনকার গড়পড়তা দৃশ্য। হাজার হাজার মাইল দূরের যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থা আরও খারাপ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মার্কিন নাগরিকেরা প্রতি পাঁচ বেলার মধ্যে এক বেলার খাবার গাড়িতে খায়। প্রতি চারজনের একজন প্রতিদিন এক বেলা ফাস্ট ফুড খায়। আর বেশির ভাগ পরিবার পাঁচ দিনের মধ্যে শুধু এক বেলা সবাই একসঙ্গে খেতে পারেন। এর মানে তারা প্রিয়জনের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সময় কাটানোর সুযোগ হারিয়ে ফেলছেন।

একসঙ্গে না খাওয়ার ফলে শরীর ও মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। কর্মব্যস্ত জীবনে সবাই শুধু ছুটে চলছে। কারও যেন সময় নেই দুদণ্ড বসার। এ কারণে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপে থাকছেন কমবেশি সবাই। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য, এভাবে মানসিক চাপে থাকলে মানুষের হৃদ্রোগ ও স্ট্রোক হতে পারে। আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাম্প্রতিক এক গবেষণাও সেদিকেই ইঙ্গিত করছে। তাদের মতে, এ চাপ কমানোর একটি পন্থা পরিবারের সবাই একটা নির্দিষ্ট সময় একসঙ্গে কাটানো। হতে পারে সেটা একসঙ্গে বসে খাওয়া।

দেশজুড়ে এক হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর এ গবেষণা চালায় তারা। অংশগ্রহণকারীদের ৮৪ শতাংশ ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে যদি তারা এক বেলা খাবার খেতে পারতেন! আর অভিভাবকদের প্রায় সবাই বলেছেন, নিয়মিত খাবার টেবিলে একসঙ্গে বসার কারণে তাদের সবার দেখা হয়, কথা হয়। এতে মানসিক চাপ অনেকটাই কমে যায়।

সন্দেহহীন সুখের সংসারসন্দেহহীন সুখের সংসার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক ওয়াসিফা তাসনিম বলেন, ‘যৌথ পরিবারে খাবার টেবিলের আড্ডায় কমে যেত দৈনন্দিন জীবনের হতাশা, ব্যর্থতা, মানসিক চাপ। আজকের শহুরে জীবনের একক পরিবারে যা কম দেখা যায়। এতে সমাজ আর পরিবারের সঙ্গে ব্যক্তির বিচ্ছেদ আর বিচ্যুতি শুরু হয়েছে। তৈরি হয়েছে মানসিক ও শারীরিক জটিলতা।’

বিশ্বের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো–অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট জানিয়েছে, যেসব ছেলেমেয়ে মা-বাবার সঙ্গে নিয়মিত খাবার খায় না, স্কুলে তারা বেশি ভুল করে।

২০১৪ সালের মে মাসে বুলগেরিয়ায় স্থূলতা সম্পর্কিত ইউরোপীয় কংগ্রেসে একটি গবেষণা উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, যে শিশুরা সপ্তাহে অন্তত দুবারও তাদের মা–বাবার সঙ্গে রাতের খাবার খায় না, তাদের ওজন; যারা খায় তাদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি। বিপরীতে, যে শিশুরা সপ্তাহে পাঁচ বা তার বেশি দিন পরিবারের সঙ্গে খায়, তাদের মাদকের প্রতি আসক্তি কম তৈরি হয়। একই সঙ্গে তারা স্বাস্থ্যকর খাবার খায়, পড়াশোনায় ভালো করে, ঘনিষ্ঠ হয় মা–বাবার সঙ্গে সম্পর্ক।

মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক মিশেল পোল্যান তার ‘কোকড’ বইয়ে লিখেছেন, বাড়ির বাইরে খাবার খাওয়ার দুটি খারাপ দিক আছে। প্রথমত এসব খাবার অস্বাস্থ্যকর। আর অপরটি হলো একাকিত্ব। খাবার টেবিল মূলত সবাইকে একত্র করার জায়গা। সবাই মিলে খাবার খাওয়ার মানে হলো কথা বলার সুযোগ। যেখানে সবাই তাদের কাজকে এক পাশে রেখে একটি ভালো সময় কাটায়।

এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দিনের মধ্যে অন্তত একবার পরিবারের সকলের সঙ্গে খাবার খাওয়াটা শুধুই সংস্কার নয়, এর কিছু বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা রয়েছে। প্রথম এবং প্রধান উপকারিতাটি কিন্তু শিশু-কিশোরদের। এই বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা-ভয় কাজ করে। রাতের খাবারে পরিবারের সবাইকে একসঙ্গে পেলে তাদের আত্মবিশ্বাস ও পরিবারের প্রতি আস্থা বেড়ে যায়। তারা অনেক বেশি সুরক্ষিত বোধ করে।

২০১৬ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে ৭১ শতাংশ টিনএজার মনে করে যে ডিনার খাওয়ার থেকেও বেশি তারা পছন্দ করে ওই সময় বাড়ির সকলের সঙ্গে গল্প করা বা দেখা হওয়া।

দেখা গেছে, যে সব পরিবারে এই চল রয়েছে, সেই পরিবারের শিশুরা পড়াশোনায় বেশ এগিয়ে থাকে। ‘কাসা’-র একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, যে সব বাচ্চারা সপ্তাহে অন্তত ৫-৭দিন পরিবারের সবার সঙ্গে বসে ডিনার করতে পারে, তাদের মধ্যেই ‘এ’ এবং ‘বি’ গ্রেড পাওয়ার সংখ্যা বেশি।

২০০৮ সালে, আইবিএম সংস্থার কর্মীদের মধ্যে একটি সমীক্ষা করে ব্রিঘাম ইয়ং বিশ্ববিদ্যালয়। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, ফ্যামিলি ডিনার যে কোনও ধরনের স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে। কাজের জায়গায় দীর্ঘক্ষণ কাটানোর পরে বাড়ি ফিরে এসে সবার সঙ্গে একসঙ্গে বসে ডিনার করলে অনেকটা স্বস্তি আসে।

প্রত্যেকেই চান, ডিনারে গরম গরম খাবার পরিবেশিত হোক। সবাই মিলে একসঙ্গে না খেলে, বার বার খাবার গরম করার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এর ফলে খাবারের খাদ্যগুণ অনেকটা কমে যায়। রান্না করার সময়ে এমনিতেই খাদ্যগুণ কমে যায় ২৫ শতাংশ। এর পরে সেই খাবার ফ্রিজে রাখলে আরও ৫ শতাংশ কমে খাদ্যগুণ। তার পরে আবারও গরম করলে খাদ্যগুণ কমে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ।

একসঙ্গে ডিনার সারার অভ্যাস থাকলে জীবনযাপনে অনেক বেশি শৃঙ্খলা আসে। কারণ এর জন্য নির্দিষ্ট সময়ে বাড়ি ফিরতেই হয় এবং ডিনারের পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তৈরি হয়। কাজের প্রয়োজনে, বা কখনো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের কারণে ফ্যামিলি ডিনার বাদ দিয়ে বেশি রাতে ফেরা যায় কিন্তু এমনটা প্রতিদিন হলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব একটা ভালো না।

রাতে পরিবারের সঙ্গে ডিনারের অভ্যাস থাকলে স্বাভাবিকভাবেই নিয়মিত বাইরে খাওয়ার ঝোঁকটা কমে। পৃথিবীজুড়ে সমস্ত নিউট্রিশনিস্ট ও লাইফস্টাইল বিশেষজ্ঞদের এই ব্যাপারে কোনও দ্বিমত নেই যে বাড়ির খাবারই নিয়মিত খাওয়া শরীর-স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো।

এক সঙ্গে বসে খাবার খেলে আপনার সন্তানও পাবে অনেক উপকার। চলুন জেনে নেই কীভাবে আপনার সন্তান একসঙ্গে খাবার খাওয়ার মাধ্যমে এগিয়ে থাকতে পারে অন্য বাচ্চাদের থেকে।

আপনার সন্তান সঠিক খাদ্যাভ্যাস শিখবে একটি সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে, পরিবারের প্রতিটি সদস্য বিশেষত কিশোর-কিশোরীরা এক সঙ্গে বসে খাবার খেলে তাদের সামগ্রিক ডায়েট ভালো হয়। যে সমস্ত কিশোর-কিশোরীরা পরিবারের সঙ্গে বসে খাবার খায়, তাঁরা ফাস্ট ফুড ও শর্করা যুক্ত খাবারের পরিবর্তে অধিক পরিমাণে ফল এবং সবজি খেয়ে থাকে।

গভীর সাইকোসোশ্যাল বিষয় প্রতিরোধ করে
২০১৫ সালে ক্যানাডিয়ান সমীক্ষকদের একটি রিভিউ থেকে জানা যে, পরিবারের সঙ্গে বসে আহার গ্রহণ করলে কিশোরদের খাবারের বিশৃঙ্খলা, মদ্যপান ও অনুপযুক্ত খাদ্যবস্তুর সেবন, হিংস্র ব্যবহার, অবসাদ এবং আত্মহত্যার চিন্তা ভাবনা প্রতিরোধ করা যায়। রিভিউ থেকে জানা গিয়েছে যে, কিশোরীরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বসে খাবার খাওয়ার উপকারিতা উপভোগ করতে চেয়েছেন।

স্থূলতার সম্ভাবনা কম করা যায়
জার্নাল অফ পিডিয়াট্রিকসে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে, পরিবারের সঙ্গে বসে আহার করা এবং স্থূলতা কম করার মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। ১০ বছর পর এর সুফল লাভ করা যাবে। এই সমীক্ষায় বলা হয় যে, প্রতিটি পরিবারকে প্রতি সপ্তাহে এক বা দুবার এক সঙ্গে বসে খাবার খাওয়া উচিত। এর ফলে পরবর্তী জীবনে তাদের সন্তানরা ওজন বৃদ্ধির সমস্যা থেকে দূরে থাকতে পারবে।

বাচ্চার আত্মবিশ্বাস বাড়তে পারে
খাবার খাওয়ার সময় কথাবার্তার মাধ্যমে সন্তান অভিভাবক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে যে নিরাপত্তা অনুভব করতে পারে, তা তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়, এমনই মত প্রকাশ করেন স্ট্যানফোর্ড চিলড্রেনস হেল্থ-এর বিশেষজ্ঞরা। সন্তানের কাছ থেকে তাদের দিন কেমন কাটল, তারা কী করল ইত্যাদি জানতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে আসলে আপনারা তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, তারাও গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনারা তাদেরও সম্মান করেন। বাচ্চাদের নিজের খাবার টেবিল নিজে বেছে নিতে দিন। পাশাপাশি খাবারের প্রস্তুতি সংক্রান্ত কিছু কাজ যেমন খাবার পরিবেশন বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার কাজ করতে দিন।

যোগাযোগের স্কিল বাড়ায়
২০১৮ সালে একটি সমীক্ষা থেকে জানা গিয়েছে যে সমস্ত পরিবারের ৬ বছরের বাচ্চাদের খাবার টেবিলের অভিজ্ঞতা সুখপূর্ণ এবং ইতিবাচক, তারা ১০ বছর বয়সে এসে তার সুফল লাভ করে। সাধারণ স্বাস্থ্য ও ফিটনেসের পাশাপাশি খাবার টেবিলে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর বিষয় কথোপকথন তাদের সমৃদ্ধ করে তোলে এবং তাদের যোগাযোগের স্কিল বাড়ায়।তাই নিজেকে ও পরিবারকে সুস্থ রাখতে অন্তত একবেলা একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়াটা জরুরি।

খবর সারাবেলা / ৩১ অক্টোবর ২০২৩ / এমএম