লেখক চাইলেই ফ্রি বই দিতে পারেন

প্রচুর বই পড়ি বলে, বই বের করার আগে আমার নিজেরও একটা ধারণা ছিল, লেখক চাইলেই ফ্রি বই দিতে পারেন। সে নিজেই যেহেতু লিখেছেন, তার মানে তার প্রকাশিত সব বই-ই তার জিম্মায় থাকে। চাইলেই যাকে ইচ্ছা তাকে ফ্রি বই উপহার দিতে পারে!

বই প্রকাশ করার পর দেখি, ব্যাপারটা এত সহজ কিছু না। বইয়ের জন্য লেখক অর্থলগ্নি করেন না, যিনি করেন তিনি হলেন প্রকাশক। ৩/৫/১০ কপি লেখক কপি বাদে একজন লেখককে অতিরিক্ত কপি বই নিতে হলে প্রকাশক থেকে টাকা দিয়ে নিজের বইও কিনে নিতে হবে! আগে কেমন বোকার স্বর্গে বাস করছিলাম আমি; ভেবেই হাসি পায় এখন! বুঝলাম, আমার মতো অধিকাংশ মানুষের মনে এই ভুল ধারণাটা এখনো বিদ্যমান।

একজন লেখক পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার পর, প্রকাশক সেটা এডিটর ও প্রুফ রিডারের কাছে পাঠান বানান বা বাক্যগঠন চেক করাতে। সেই সাথে প্রচ্ছদশিল্পী প্রচ্ছদ ও ইলাস্ট্রেশন করেন, মেকাপ ও গ্রাফিকসের কাজগুলো করা হয় এরপর। আরো কী কী হয়, আমি নিজেও এখনো জানি না পুরোপুরি। বইয়ের কাগজ, কাভারের কাগজ, আঠা, প্লেট এসব কিনে পাঠানো হয় ছাপাখানায়। সেখানে ছাপা হওয়ার পর বাইন্ডিং, শুকানো হয়। তারপর বই হাতে পেয়ে ৪০-৫০% ছাড়ে অনলাইন বুকশপে দেওয়া হয় বিক্রির জন্য।

এখন এই যে একটা বইয়ের মলাট মূল্য ৩০০ বা ৩৫০ টাকা লেখা– এই ৩০০ টাকা থেকেই প্রকাশক এক এক করে পে করে দেন এডিটর, প্রুফ রিডার, গ্রাফিকস ডিজাইনার, প্রচ্ছদশিল্পী এবং প্রেসে। নিজের বইয়ের ক্ষেত্রে যা দেখেছি, এই বিলগুলো বই প্রকাশের আগেই কিংবা সাথে সাথেই পরিশোধ করা হয়ে থাকে। শুধু কার বিলটা এ সময় পরিশোধ করা হয় না, জানেন? লেখকের! (স্বনামধন্য লেখক ব্যতিক্রম!) হ্যাঁ, যিনি তার কন্টেন্ট জমা না দিলে বইটাই করা যেত না; তার কাছেই বিল পৌঁছায় সবার শেষে, প্রথম মুদ্রণ শেষ হওয়ার পরে এবং সেটা এতই সামান্য পরিমাণ যে তার প্রফেশনের অফিশিয়াল মাসিক বেতনের তিন ভাগের এক ভাগও না!

এরকমটা হওয়ার কারণ, লেখকের সাথে চুক্তি থাকে, যে তার বই ২০০/৪০০ বা প্রথম মুদ্রণ শেষ হওয়া অবধি তিনি কোনো রয়্যালটি পাবেন না। এখন প্রতি বইয়ে ১০% হারে ৩০০ টাকার কোনো বইয়ের প্রথম মুদ্রণ ৩০০ কপি শেষ হলে লেখক পাবেন মাত্র ৯০০০ টাকা— যেটা দিয়ে অনেকেই তাকে ‘বড়োলোক’ হয়ে গেছেন, বোঝান! এখন প্রথম মুদ্রণের ওই ৩০০ কপি বই লেখক কিংবা বই ভেদে ১০ দিনেও শেষ হতে পারে, এক বছরও লাগতে পারে…. আবার কারো কারো ক্ষেত্রে ৫ বছরও লেগে যায়! এভারেজ হিসেব করলে একজন লেখক তার একটি বইয়ের প্রথম মুদ্রণের ৩০০ কপি বইয়ের জন্য এক বছরে ৯০০০ টাকা পেয়ে, তবে কি ‘বড়োলোক’ তকমা জুটাতে সক্ষম হয়ে আনন্দিত হচ্ছেন না কি আপনার কথা তার মনে আঘাত দিচ্ছে, তা এখন আপনি নিজেই বিচার করেন, প্লিজ।

একটা সত্যি এবং দুঃখজনক কথা শেয়ার করি…. অনেক সময়েই দেখা যায় মুদ্রণের পর মুদ্রণ বই শেষ হয়ে গেলেও লেখকের রয়্যালটি পরিশোধ করা হয় না! জি হ্যাঁ, হয় না। মানে বলতে গেলে, লেখকের লেখা সেল করে অনেকেরই জীবিকার যোগান হলো ঠিক… মাঝখান দিয়ে লেখক বেচারা তার বছরের পর বছর ধরে শ্রম, মেধা, কল্পনা, সময়, আবেগ খরচ করে পাঠকের জন্য যে কন্টেন্ট তুলে দিলেন; তার কোনো পারিশ্রমিকই তার হাতে এসে পৌঁছায় না, জানেন???

এতকিছুর পরেও যারা আমার বই কিনে পড়েন, প্রতিনিয়ত লিখতে উৎসাহিত করেন; তাদের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা। এই লেখাটি তাদের জন্যই যারা ভাবেন, সুস্মিতার বই কিনে পড়ে বা কাউকে উপহার দিয়ে; ওকে বড়োলোক বানায় দিয়ে আমার কী লাভ? তার চেয়ে কয়েকবার করে পড়া বিখ্যাত লেখকের বই কিনি, যাই! আমি ‘বড়োলোক’ হওয়ার জন্য সেই শৈশবে মাত্র ৬ বছর বয়স থেকেই লেখালিখি শুরু করিনি। আমি লিখি কিংবা লিখতে শুরু করেছিলাম ‘লেখক’ পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই বলে। বাংলাদেশে শুধু লিখে ক্যারিয়ার গড়া কোটিতে একজনের জন্য হয়তো সম্ভব হলেও হতে পারে! পত্র-পত্রিকায় লিখে হাত পাকিয়ে লেখক হওয়ার পর বই লিখে বুঝেছি, এই দেশে লেখক আর যাই হোক, কখনও ‘বড়োলোক’ হতে পারে না! মনে রাখবেন, লেখক আপনাকে উপহার হিসেবে তার নিজের লেখা যে বইটি দিলেন— তা তিনি প্রকাশকের কাছ থেকে কিনেই আপনাকে দিয়েছেন!

লেখাটির ব্যাপারে আমাকে কেউ ভুল বুঝবেন না প্লিজ। আমি জাস্ট ভুল ধারণাটুকু শুধরে দিলাম। আর কয়েকদিন ধরে আশেপাশের মানুষের কাছ থেকে শোনা কিছু কথার মনোকষ্ট থেকেই মূলত লেখাটির অবতারণা।

খবর সারাবেলা / ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ / এমএম