‘হাওয়া’ বাংলা চলচ্চিত্রে দখিনা হাওয়া

‘হাওয়া’ সিনেমায় ব্যবহৃত গীতিকার হাশিম মাহমুদের গানে তিনি বলেছেন- ‘পিরিত ভালা গলার মালা বললে কি আর হয়’, হাশিম মাহমুদ ঠিকই বলেছেন পিরিত বা ভালোবাসা এমনি এমনি হয়না। ‘হাওয়া’ সিনেমাটি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। সিনেমার গান দিয়ে সিনেমা হিট এটাই প্রথম নয় এর আগেও হয়েছে। তবে হাওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য রকম সিনেমা দেখারপর গানের মতো ভালোবাসা সৃষ্টি হয়েছে দর্শকের হৃদয়ে। গত ২৯ জুলাই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ সিনেমা।

‘হাওয়া’ যে দর্শকের কাঙ্ক্ষিত সিনেমা তা বোঝা যায় হাউজ ফুল আর দর্শকের লম্বা লাইন দেখে। কোন প্রকার মূলামুলি না করেই বলতে পারি হাওয়া বাংলা চলচ্চিত্রে শুভকর হাওয়া বয়ে এনেছে। বাংলা সিনেমার জন্য দর্শকের লম্বা লাইন অনেক বছর পরে দেখা যাচ্ছে যা নির্দ্বিধায় আনন্দের।

শুধু ধারণা নয়, ‘হাওয়া’ সিনেমার গল্প, নির্মাণশৈলী এবং অভিনয়ের নিপুণতা দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বইয়েছে দর্শকের হৃদয়ে। ‘হাওয়া’ সিনেমায় গভীর সমুদ্রে জেলেদের জীবনের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। গভীর সমুদ্রে জেলেদের সঙ্গে ঘটা অলৌকিক এক গল্প তুলে ধরা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। যা হয়তো শহুরে মানুষদের কাছে রূপকথার গল্প। কিন্তু সমুদ্রপাড় বা গভীর সমুদ্রের জেলেদের কাছে এটাই জীবন এবং বাস্তবতা। একদল জেলে মাছ ধরতে গভীর সমুদ্রে যায়। সেখানে ঘটতে থাকে নানা মজার ঘটনা। এ যাত্রার প্রথম দিকে চাঁন মাঝি মাছ পেতে শুরু করে তবে হঠাৎ একদিন রাতে জালে উঠে আসে এক বেদে নারীর লাশ প্রথম দিকে সবাই ধারণা করে নারীটা মৃত তবে কিছুক্ষণ পরে তাদের ধারণা বদলায় মেয়েটা চোখ খুলে এবং তখনি সবাই জানতে পারে মেয়েটা বেঁচে আছে। সেখান থেকেই বেড়ে উঠে গল্প। সাধারণত গভীর সমুদ্রে মেয়েদের থাকাতে প্রথাগত এবং কোস্টগার্ডের পক্ষ থেকে নিয়ম রয়েছে। তাই জেলেরা মেয়েটিকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে বলে।

অন্যদিকে ট্রলারে নারীর উপস্থিতিতে জেলেদের ভাবগতিক পরিবর্তন হতে থাকে। সবাই চেষ্টা করে নারীটির সঙ্গে ভাব জমাতে। তবে ট্রলারের ইঞ্জিন মিস্ত্রি ইব্রাহিমের বেশ আগ্রহ হয় রহস্যময় সেই নারী সম্পর্কে জানবার। মেয়েটি বোবা হবার জন্য ইব্রাহিম তেমন ভাবে কিছুই জানতে পারেনা৷ সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গল্পের মোড় বদলাতে থাকে। সমুদ্রে মাছের মৌসুম ভালো যাচ্ছিলো কিন্তু চাঁন মাঝির ট্রলারে মাছ নেই। একটা সময় ইব্রাহিম জানতে পারে নারীটি কথা বলতে পারে তার নাম গুলতি। ট্রলারে গুলতির ভালো বন্ধু হয় ইব্রাহিম কারণ সবাই তার সুযোগ নিতে চেয়েছে কেবল ইব্রাহিম ছাড়া।

এছাড়া জেলেরা একের পর এক বিপদে পড়তে থাকে। জেলেদের ভাষায় কালাজাদু ভর করছে তাদের উপর। সমুদ্রে পাতা জাল হারিয়ে যাওয়া, ট্রলারের তেলের ট্যাংকি ছিদ্র হয়ে যাওয়া এবাবেই ক্রমশ রহস্যময় হতে থাকে গল্প। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে দূর আকাশে উড়তে থাকা ক্ষুধার্ত চিলের মতো দর্শক অপেক্ষায় থাকে পরবর্তী ঘটনার। নারীটি যে রহস্যময় তা বোঝার বাকি থাকেনা দর্শকের। নারীটি যে তার বাবার হত্যাকারী ডাকাত চাঁন মাঝির উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছে এখানে তা কিন্তু একসময় দর্শক জানতে পারে।

আমরা বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বলতে যা বুঝি হাওয়া তার ব্যতিক্রম। এমন চলচ্চিত্র ব্যবসা সফল হবে এটা বাংলা চলচ্চিত্রে বিরল। এক কথায় বললে হাওয়া নতুন দিগন্ত প্রসারিত করছে। সিনেমার অভিনয়ের দিকে তাকালে প্রথমেই বলতে হয় নাগু চরিত্রে নাসির উদ্দিন খান ছিলো অসাধারণ তার অভিনয় দর্শককে মজা দিয়েছে। তিনি একাই বয়ে নিয়ে গিয়েছে প্রথম পর্ব। চাঁন মাঝি চরিত্রে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় ছিলো অনবদ্য। চঞ্চল মানেই দর্শকের মনে চঞ্চলতা এটা তিনি আবার প্রমাণ করলেন।

শরিফুল রাজ ও নাসির উদ্দিন খান
ইব্রাহিম চরিত্রে শরিফুল রাজের অভিনয় প্রাণবন্ত তিনি যে একজন ভালো অভিনেতা তার প্রমাণ পেয়েছে দর্শক। অন্যদিকে এজা চরিত্রে সুমন আনোয়ারের অভিনয় চোখে পড়লেও। অনেক সময় মনে হয়েছে তিনি পুরোপুরি পারেননি চরিত্রে ঢুকতে। গুলতি চরিত্রে নাজিফা তুষির অভিনয় ছিলো চোখ ধাঁধানো। তার চাহনি সংলাপ সকল কিছুই দর্শকের মন কেড়েছে। চলচ্চিত্রে সকল অভিনেতাই তাদের সেরাটা দিয়েছে।

চলচ্চিত্রের প্রথম অংশ বেশ মজার ছিলো। মজার ছলেই চরিত্রগুলোকে চেনানো হয়েছে। দর্শক হেসেছে প্রাণ খুলে। সিনেমার দ্বিতীয় অংশে রহস্য এবং রোমাঞ্চকর সাথে আবেগও প্রকাশ পেয়েছে।

দর্শক আঁতকে উঠেছেন শেষ দিকে। শেষের অংশে দর্শক ভয় ও কষ্টও পেয়েছে। চলচ্চিত্রটি দুই ঘণ্টার যেখানে দর্শকের মনে হয়েছে তিনিও চলচ্চিত্রের একটা অংশ এবং তিনিও গভীর সমুদ্রের ভেসে বেড়াচ্ছে। এটাই হাওয়ায় সার্থকতা।

চঞ্চল চৌধুরী
চলচ্চিত্রের সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে বললে বলতে হয় কামরুল হাসান খসরু একজন গুণী চিত্রগ্রাহক তার প্রমাণ রেখেছেন চলচ্চিত্র জুড়ে। সিনেমাটোগ্রাফি চলচ্চিত্রটিকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়। পুরো সিনেমাটি শুটিং হয়েছে একটি ট্রলারে তবে দর্শক একবারও বিরক্ত হয়নি। পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন এখানে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে চলচ্চিত্রে আরও শটের নৈপুণ্যতা প্রকাশ পেতে পারতো।

সিনেমার লাইটের দিকে তাকালে বলতে হয় পরিচালক এখানে আবারও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। লাইট ছিলো এক কথায় অসাধারণ। পোশাকের বিষয়েও পরিচালক বেশ গুরুত্ব দিয়েছে যা চলচ্চিত্রকে অন্য মাত্রায় তুলে ধরেছে। সিনেমা জুড়ে অভিনেতাদের মেকআপ ছিলো অসাধারণ যা প্রতিটি সিনকে নিয়ে এসেছে সামনের সারিতে। এখানেও পরিচালক ধন্যবাদ পায়।

‘হাওয়া’ টিম
পুরো সিনেমায় একটি গান ব্যাবহার করা হয়েছে। যা হাশিম মাহমুদের লেখা ও সুর করা। মিউজিকটি পরিচালনা করেছেন ইমন চৌধুরী। ইমন একজন গুণী শিল্পী তা তিনি অনেক আগেই জানান দিয়েছে। তিনি আরও একবার তার কাজের প্রমাণ রেখে গেলেন। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন এরফান মৃধা শিবলু। তিনি প্রাণ দিয়ে গেয়েছেন গানটি। নির্দ্বিধায় বলতে পারি গানটিই পুরো সিনেমাকে বহন করেছে।

সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমনের প্রথম চলচ্চিত্র এটি। পরিচালনায় তার হাতের নৈপুণ্যটা প্রকাশ পেয়েছে চলচ্চিত্র জুড়ে। বাংলা সিনেমার দর্শকদের রুচির থেকে বড় কথা পরিচালকদের রুচি বদলাচ্ছে এবং তরুণ মেধাবী নির্মাতারা সাহস দেখাচ্ছে চলচ্চিত্র নির্মাণের। তাই বলা যায় তরুণরা বরাবরই সাহসী। পরিচালকদের রুচি বদলালেই তৈরি হবে ভালো চলচ্চিত্র সেক্ষেত্রে দর্শকের রুচিরও পরিবর্তন ঘটবে। হাওয়া হচ্ছে একজন শিল্পীর নিপুণ হাতের কারুকার্যতা। হাওয়া সিনেমা একটি শুভ হাওয়া বয়ে এনেছে চলচ্চিত্র অঙ্গনে যা অব্যাহত থাকুক চিরকাল।

লেখক: সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

খবর সারাবেলা / ০২ আগস্ট ২০২২ / এমএম