স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা
আমাদের প্রিয় নবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) ব্যবসাকে একটি উত্তম পেশা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। কিন্তু স্পষ্টভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, ব্যবসা ততক্ষণ পর্যন্ত উত্তম পেশা হিসাবে গৃহীত হবে, যতক্ষণ তা হালাল থাকবে। নবি করিমের (সা.) নির্দেশ-‘ব্যবসায় অর্জিত অর্থ হালাল হিসাবে গণ্য হবে, যদি পণ্যের মূল্য ক্রেতা ও বিক্রেতার সন্তুষ্টি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়।’
মহানবির (সা.) বাণী কি আমরা অনুসরণ করছি? বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত একটি দেশ, যেখানে ব্যবসায়ীদের শতকরা অন্তত ৮০ জনই মুসলমান। পৃথিবীর অমুসলিম প্রধান দেশে ক্রিসমাস বা পূজা পার্বণের সময় স্বর্ণ-হীরা-রৌপ্য ছাড়া সব পণ্যের মূল্য কমিয়ে দেওয়া হয়, যেন সাধারণ মানুষ ক্রয় ও আনন্দ-উৎসব উপভোগ করতে পারেন।
আর আমাদের দেশে রোজার মাস শুরু হওয়ার আগে থেকেই একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী খাদ্যদ্রব্য গোপনে গুদামজাতের মাধ্যমে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। মূল্য বাড়িয়ে গরিব রোজাদারদের অভুক্ত রেখে ধনী থেকে আরও ধনী হওয়ার পূর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে তৎপর হয়। এ প্রসঙ্গে একটি পুরোনো গল্প প্রচলিত আছে।
এক ব্যবসায়ী হজ শেষে ফিরে এলে লোকজন তার দোকান থেকে আরও বেশি বেশি ক্রয় করতে থাকে। ক্রয় বেড়ে যাওয়ার সুযোগে ব্যবসায়ী পণ্যের দামও বাড়িয়ে দেয়। ফলে ফুলেফেঁপে ওঠে তার ব্যবসা। এমন অবস্থা দেখে তার পুত্রধন আক্ষেপ করে বাবাকে বলে, ‘আব্বা, তুমি কেন আর দুবছর আগে হজটা করলে না!’ ধিক এই ব্যবসায়ীর প্রতি। জানি না মহানবির উম্মত হওয়ার যোগ্যতা এমন ব্যক্তির আছে কিনা।
আমাদের ছোটবেলায় ‘সিন্ডিকেট’ নামক শব্দটির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না। নিশ্চয়ই এটি ইংরেজি অভিধানে ছিল, কিন্তু পত্রপত্রিকা কিংবা পাঠ্যবইয়ে সিন্ডিকেটের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। বছর বিশ/পঁচিশ আগে হঠাৎ শুনতে পেলাম, চালের দাম আকস্মিক বৃদ্ধির পেছনে সিন্ডিকেটের কারসাজি রয়েছে। তখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি এ সিন্ডিকেটরা কীভাবে বাজারের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
এটি বোঝার জন্য বইপত্র ঘেঁটে যেটুকু বুঝতে পারলাম তা হলো-যে ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ব্যবসায়িক লেনদেন ও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার্থে একতাবদ্ধ হয়ে একই নীতি অনুসরণ ও বাজার কব্জা করে, ওই গোষ্ঠীকেই সিন্ডিকেট বলা হয়। এখানে মহানবি হজরত মুহাম্মদের (সা.) আদর্শ বাণী উপেক্ষিত। এখানে ক্রেতার স্বার্থ রক্ষা অস্বীকার করা হয়। দেশে বর্তমানে এ সিন্ডিকেট গোষ্ঠী মূর্তিমান এক আতঙ্ক, এক ধরনের রক্তচোষা অদৃশ্য সরীসৃপের মতো।
২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়লে প্রায় প্রতিটি দেশ নিজ নিজ ভূখণ্ডে লকডাউন ঘোষণা করে। এর ফলে এক দেশ থেকে অন্য দেশে পণ্য পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, দেশের এক স্থান থেকে অন্য স্থানেও পণ্য পরিবহণ বন্ধ থাকে। দেশের অর্থনীতির প্রবাহ স্থবির হয়ে যায়।
সরকারি নির্দেশে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে তাদের গৃহবন্দি করে রাখা হয়। এতে সবচেয়ে ভোগান্তি হয় দৈনিক খেটে খাওয়া মানুষের। একদিকে পণ্য সংকট, অপরদিকে আয় বন্ধ। এমন কঠিন অবস্থায়ও দেশে এ সিন্ডিকেট কব্জা করে রেখেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য। সরকার, দুই-একটি এনজিও এবং সমাজের বেশকিছু মানুষ, বিশেষত যুবসমাজ মানবিক হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ওইসব অভুক্ত মানুষের দিকে। সরকার দ্রুত পোশাক কারখানা ও অন্যান্য শিল্প-কারখানা খুলে দেওয়ায় মানবিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ।
অথচ ওই কঠিন সময়েও সিন্ডিকেট নামক পাষাণ হৃদয়ের মানুষগুলো পণ্যগুলোর কৃত্রিম সংকট, বিশেষত চাল, ডাল, তেল, চিনির কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে কষ্ট দিয়েছে। শুধু যে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের বেলায় এমনটি ঘটেছে তা নয়, জীবন বাঁচানোর অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়েও তারা ব্যবসা করেছে।
হাসপাতালের বারান্দায় অনেক মানুষ অক্সিজেনের অভাবে কষ্ট পেয়ে ধুঁকে ধুঁকে মারা গেছে। অপরদিকে এ সময়ে বেশকিছু তরুণ-যুবক চাঁদা তুলে অথবা নিজ পকেটের পয়সায় রাস্তায়, অলিগলিতে অনাহারি মানুষকে খাইয়েছে, মোটরসাইকেল চালিয়ে পিঠে অক্সিজেনের সিলিন্ডার বহন করে করোনা আক্রান্ত রোগীর বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছে। স্যালুট তাদের। তারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত উত্তরাধিকার। তাদের জন্য গর্বে আমাদের বুক ভরে যায়। শত ঝড়-ঝঞ্ঝা ও ষড়যন্ত্রের মাঝেও তারা মেরুদণ্ড উঁচু করে রক্ষা করবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
২০২২ সালের শুরুতে করোনা যখন কিছুটা নিয়ন্ত্রিত, তখন দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। রপ্তানি ও বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স বাড়তে থাকলেও সত্যিকার অর্থে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা ওই সিন্ডিকেট, মজুতদার, মিল মালিকদের কাছেই জিম্মি হয়ে থাকে। নিত্যদিনের খাদ্য তালিকায় ওই গোষ্ঠীর কালো হাত যেন আরও কঠিন হয়ে যায়। এ মানুষরূপী দানবদের কারণে অসহায় মানুষের রোজগার ও খাদ্যের পরিমাণ দিন দিন কমতে থাকে। তখন থেকে সীমিত আয়ের মানুষের খাদ্য তালিকা ছোট হয়ে আসছে। মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে মারাত্মকভাবে।
এ মূল্যবৃদ্ধির পেছনে শুধু যে সিন্ডিকেট দায়ী তা নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে এমন কোনো পেশার মানুষ নেই, যারা রাজনীতির দলাদলিতে আক্রান্ত নয়। যারা দ্রুত সরকারের পতন চান, তারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও এমন সুচতুরভাবে কাজ করেন, যা ক্রেতাদের মধ্যে অধিক হারে ক্রয়ের প্রবণতা, বিক্রেতাদের মজুত-পণ্য সংকট ও মূল্যবৃদ্ধিতে উৎসাহ জোগাচ্ছে। বিরোধী রাজনীতিকরা সভা-সমাবেশে চিৎকার করে বলতে থাকেন ডলারসহ পণ্য ঘাটতি, দ্রব্যমূল্যের চলমান ঊর্ধ্বগতির কথা। শ্রীলংকার মতো অবস্থা হবে বাংলাদেশের, এমন হতাশাব্যঞ্জক ভবিষ্যদ্বাণী করে উসকে দেন ওইসব সিন্ডিকেটদের।
আরও লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা এ সুযোগ গ্রহণ করে। এতে কিন্তু সরকার বা তাদের মন্ত্রী-এমপিরা মোটেও ক্ষতিগ্রস্ত হন না। তারা দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতেও দিব্যি ভালো আছেন। তাদের বাজার-খাদ্য তালিকা বিন্দুমাত্র কাটছাঁট হয় না। বরং কতিপয় মন্ত্রীর আহাম্মকি মন্তব্যে মনে হয় তারা অসহায় মানুষদের সঙ্গে তামাশা করছেন এবং কাটা ঘায়ে লবণ দিচ্ছেন।
বিশ্বাস করে যে, টানা দুবছরে করোনার তাণ্ডব এবং বর্তমানে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির মতো ধনী দেশেও চলছে স্মরণকালের সবচেয়ে কঠিন মূল্যস্ফীতি। সেখানে বাংলাদেশকেও এর জের টানতেই হবে। রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে কঠিন বিধিনিষেধ, তাতেই মূলত বাংলাদেশের গরিব মানুষের চিড়েচ্যাপ্টা অবস্থা। তার ওপর ব্যবসায়ীদের অসাধুতা, অমানবিকতায় মানুষ খুব কষ্টে ও চরম হতাশায় আছে। স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনে চলছে নীরব খাদ্যাভাব।
৩-৪ মাস আগে তেল ব্যবসায়ীরা কিইনা তেলেসমাতি দেখাল। প্রায়ই নিজেকে প্রশ্ন করি-একজন মানুষের কত টাকা-পয়সা চাই? মানুষকে কষ্ট দিয়ে অসৎ পথে অর্জিত এ অর্থের সুবিধাভোগীদের উত্তরাধিকারীরা কি ওই সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ীদের মৃত্যুর পর পাপের দায়ভার গ্রহণ করবে? আমি দুজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে চিনি। এদের একজনের অতীত ছিল ঢাকার বস্তিতে। বাবার সঙ্গে সবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। নিজ মেধা, শ্রম, সৎ-অসৎ চিন্তার সংমিশ্রণে তিনি বর্তমানে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। তেল-আটাসহ বেশ কিছু পণ্যের বাজার ও পরিবহণ ব্যবসার নিয়ন্ত্রক।
অপরজনের পূর্বপুরুষ ছোটখাটো আড়তদার ছিলেন। নিজে এখন যে শুধু তেলের বাজারকে প্রভাবিত করেন তা নয়, বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। উভয়ই কয়েকদিন পরপর মূল্যবৃদ্ধি করে বাজার অস্থির করে তোলেন। এরা এত অর্থবিত্তের মালিক যে নিজেরাও জানেন না প্রকৃতপক্ষে তাদের ব্যালেন্স সিটের অবস্থা কী। ব্যক্তিগত জীবনে এরা বেশ ধার্মিক। পাঁচ ওয়াক্ত জামাতে নামাজ আদায় করেন। নিয়মিত দান-খয়রাত তো আছেই, প্রায় প্রতিবছর সপরিবারে হজ-ওমরাহ পালন করেন জৌলুসের সঙ্গে। এরা উভয়েই এখন প্রবীণ, তারপরও বুক চিতিয়ে অর্থ আয়ের অলিগলি, চোরাপথে হাঁটছেন। হয়তো অর্থলিপ্সার সমাপ্তি একদিন মৃত্যুতেই হবে। কেবল কবরের মাটিই হয়তো এদের উদর পূরণ করতে সক্ষম হবে, অন্য কিছু নয়।
মন্ত্রী, এমপি, চেয়ারম্যানদের ভূমিকা এ মুহূর্তে চরম হতাশাজনক। ব্যবসায়ীদের কারসাজির বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং মূল্যবৃদ্ধির পেছনে করোনা ও বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি জনগণকে না বুঝিয়ে এই ‘মাননীয়গণ’ রাজধানীতে বিলাসী রাজনীতি-ব্যবসা নিয়ে খুব বেশি ব্যস্ত। আমরা যারা সরাসরি রাজনীতি করি না কিন্তু কিছুটা চালচিত্র বুঝি, মানুষের পালস জানি-বলতে পারি, ওইসব ‘নব্য জমিদার’ ভোটের খেলায় কিন্তু পেনাল্টি নয়, মিডফিল্ড থেকে সরাসরি গোল খাবেন। তখন কারচুপির ভুয়া অভিযোগেও কাজ হবে না।
মানুষকে ঠকিয়ে, কষ্ট দিয়ে মূল্যবৃদ্ধি করা এবং সম্পদের পাহাড় গড়ার শেষ পরিণতির ওপর যদি প্রত্যেক মসজিদে ইমাম সাহেবরা নিয়মিত অন্তত দশ মিনিট বয়ান করতেন, তা খুবই কল্যাণকর হতো। মসজিদে আগত মুসল্লি, যাদের একটি অংশ ব্যবসায়ী, তাদের ওপর এই ধর্মীয় নেতাদের বয়ান যদি প্রভাব ফেলতে পারে, তাহলে হয়তো সীমিত আয়ের গরিব মানুষদের কষ্ট অনেকটা লাঘব হবে।
এই কঠিন সময়ে স্থানীয় রাজনীতিক, প্রশাসনের কর্মকর্তা, এলাকার মুরব্বি, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম এবং অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ের ধর্মীয় গুরুরা উপস্থিত হয়ে বিশ্ববাজারের অবস্থা এবং আমাদের অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব নিয়ে যদি বক্তব্য রাখেন, তাতে মানুষের হতাশা কিছুটা হলেও দূর হবে। ব্যবসায়ীদের বোঝাতে হবে, মানুষকে কষ্ট দিয়ে অর্জিত অতিরিক্ত লাভের অর্থ মৃত্যুর পর কোনো কাজে আসবে না। ইসলামে বিশ্বাসী হলে এ হারাম অর্জনের জন্য কবরে যেমন কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে, শেষ বিচারের দিনেও নবি করিমের (সা.) সুপারিশ পাওয়া যাবে না। সেই কঠিন দিনে উত্তরাধিকারীরা, যারা ওই অবৈধ সম্পদ ভোগ করেছিল, এর দায়ভার গ্রহণ করবে না। অতএব, সময় থাকতেই সাবধান।
লে. কর্নেল এটিএম মহিউদ্দিন সেরনিয়াবাত (অব.) : প্রাবন্ধিক
খবর সারাবেলা / ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ / এমএম