সরবরাহ সংকটে দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের
দেশে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য আমদানি হলেও সরবরাহ সংকটে দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের। গত কয়েক দিনের ব্যবধানে চাল, ময়দা, ডাল, পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, শুকনো মরিচ, গুঁড়োদুধ, ভোজ্য তেলসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আতংকে যখন মানুষ দিশেহারা তখন আসন্ন রমজানের আগে এভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে স্বল্প আয়ের মানুষ বিপাকে পড়েছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী, কর্মহীন মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আর মাত্র কয়েক দিন পরেই শুরু হচ্ছে পবিত্র রমজান। প্রতি বছর রমজানের আগে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়ে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, ঢাকার মৌলভীবাজারসহ দেশের বড়ো বড়ো ভোগ্যপণ্যের মোকামগুলোতে ব্যস্ততা বাড়ে পণ্য সরবরাহ ও বিপণনে। কিন্তু এবার করোনা সংকটের কারণে দীর্ঘ প্রায় এক মাস টানা সাধারণ ছুটি থাকায় বন্দরে পণ্য খালাস ও মোকাম থেকে সারাদেশে পণ্য বাজারজাত ও সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। ফলে দাম বাড়ছে নিত্যপণ্যের।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, মোকামে টাকা পাঠিয়েও যথাসময়ে মাল পাচ্ছেন না পাইকারি ব্যবসায়ীরা। বন্দরে দ্রুত পণ্য খালাস ও সারাদেশে বাজারজাত, সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না রাখতে পারলে নিত্যপণ্যের বাজারে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। ইতিমধ্যে এক শ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী এর ফায়দা লুটতে শুরু করেছে।গতকাল সোমবার রাজধানীর খুচরাবাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, ময়দা, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, শুকনো মরিচ ও গুঁড়ো দুধের দাম বেড়েছে।
গতকাল বাজারে প্রতি কেজি সরু চাল নাজিরশাইল/মিনিকেট ৬০ থেকে ৬৮ টাকা, মাঝারি মানের চাল পাইজাম/লতা ৫০ থেকে ৫৮ টাকা, মোটা চাল ইরি/স্বর্ণা ৪২ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। যা সপ্তাহের ব্যবধানে মানভেদে প্রতি কেজি চালে ৬ থেকে ৮ টাকা বেশি। খোলা ময়দার দাম বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৫ টাকা। প্রতি কেজি খোলা ময়দা বিক্রি হচ্ছে ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়।
দাম বেড়েছে সব ধরনের ডালের। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি বড়ো দানা মসুর ডাল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা, মাঝারি মানের মসুর ডাল ১০০ থেকে ১১০ টাকা ও ছোটো দানা মসুর ডাল ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়। কিন্তু সপ্তাহখানেক আগে প্রতি কেজি বড়ো দানা মসুর ডাল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা, মাঝারি মানের মসুর ডাল ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা ও ছোটো দানা মসুর ডাল ১০০ থেকে ১১০ টাকা দরে বিক্রি হয়। মুগ ডাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা, অ্যাংকর ডাল কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ছোলা ৫ টাকা বেড়ে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মসলার মধ্যে আদার দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। গতকাল বাজারে প্রতি কেজি আমদানিকৃত আদা বিক্রি হয় ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায়। যা এক সপ্তাহ আগে ছিল ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা। এছাড়া দেশি হলুদের কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা ও আমদানিকৃত হলুদে ৪০ টাকা বেড়ে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে।
দাম বেড়েছে শুকনা মরিচেরও। দেশি শুকনা মরিচ কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা ও আমদানিকৃত শুকনা মরিচ ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি রসুনের কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা। প্রতি কেজি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১৩০ টাকা।
এদিকে আবার ঝাঁজ বেড়েছে পেঁয়াজের। গতকাল বাজারে দেশি পেঁয়াজ ৫৫ টাকা ও আমদানিকৃত পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। অথচ ১০ দিন আগেও সব ধরনের পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩৫ থেকে ৪৫ টাকার মধ্যে। রাজধানীর শ্যামবাজারের এক আমদানিকারক ব্যবসায়ী জানান, করোনা সংকটের কারণে, ভারত ও মায়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে না। ফলে দাম বেড়েছে।
দাম বাড়ার তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল ও গুড়া দুধ। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলে ৩ টাকা বেড়ে ৯৩ থেকে ৯৫ টাকা ও বোতলজাত সয়াবিন তেলে ৫ টাকা বেড়ে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি কেজি ডিপ্লোমা গুড়া (নিউজিল্যান্ড) দুধে ২০ থেকে ৪০ টাকা বেড়ে ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা ও ফ্রেশ দুধে ৬০ টাকা বেড়ে ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা ও মার্কস দুধে ১৫ টাকা বেড়ে ৫৫০ থেকে ৫৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে দেশে বিভিন্ন নিত্যপণ্যের যে মজুত আছে তাতে দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই। রমজান ও করোনা সংকটকে পুঁজি করে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে পণ্য মজুত রয়েছে। প্রতি বছর দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ১৮ লাখ ৬০ হাজার টন। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার টন। দেশে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার টন। সব মিলিয়ে ভোজ্যতেলের মোট মজুত রয়েছে ১৯ লাখ ১ হাজার টন। যা চাহিদার তুলনায় ৪১ হাজার টন বেশি।
বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৭ লাখ টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় ১৭ থেকে ১৮ লাখ টন। প্রতি বছর ১০ থেকে ১২ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। এখন পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে তাই পেঁয়াজের কোনো সংকট হওয়ার কথা নয়।চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে গম আমদানি হয়েছে ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টন। যা গত অর্থবছরের এই সময়ের তুলনায় ১২ লাখ টন বেশি। মসুর ডাল আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৫৪ হাজার টন। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ৪১ হাজার টন বেশি।
ছোলা এবং পাম অয়েল আমদানি হয়েছে যথাক্রমে ২ লাখ টন ও ৯ লাখ ৯১ হাজার টন। যা গত অর্থবছরের তুলনায় ছোলা ১ লাখ ৪০ হাজার টন এবং পাম অয়েল ৪০ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে।বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছেন, দেশে চাহিদার তুলনায় বেশি পরিমাণে নিত্যপণ্যের মজুত রয়েছে। তাই কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না। এছাড়া এরই মধ্যে টিসিবির মাধ্যমে সারাদেশে বিভিন্ন নিত্যপণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। পাশাপাশি বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কোনো অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খবর সারাবেলা / ২১ এপ্রিল ২০২০ / এমএম