সরকারের বেঁধে দেওয়া দর কখনোই মানে না ব্যবসায়ীরা
কোনো ভোগ্যপণ্যের বাজার অস্থির হলে ভোক্তাদের স্বার্থে সরকার সেই পণ্যের দর নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু কখনোই নির্ধারিত দরে খুচরা বাজারে সেই পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায় না। ভোক্তাদের এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তারা বলেন, যদি নির্ধারিত দরে সেই পণ্য বিক্রি না-ই হবে, তাহলে কেন তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়?
গত সোমবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকার ভোজ্য তেলের দর পুনর্নির্ধারণ করলেও খোদ ব্যবসায়ীরাই মানছেন না সেই দর। খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল নির্ধারিত দরের চেয়ে ৮ টাকা বেশিতে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া দাম বাড়ায় পাম অয়েলকে পাম সুপার হিসেবে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পাম সুপারের দাম গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে লিটারে পাঁচ টাকা বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনন্দিন বাজারদরের প্রতিবেদনে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে খোলা সয়াবিন তেল বিক্রির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। বেশি দামে বিক্রির বিষয়টি জানিয়েছেন ভোক্তারাও।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শুধু এবারই নয়, এর আগে কখনোই সরকার নির্ধারিত কোনো ভোগ্যপণ্যের দরই ব্যবসায়ীরা মানেনি। তারা নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে সেই পণ্য বিক্রি করেছে। অথচ সেই পণ্যের দাম নির্ধারণের সময় তারাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। গত বছর করোনা মহামারি ও চার দফা বন্যার কারণে যখন চালের বাজার অস্থির, এ অবস্থায় মিল মালিকদের পাশাপাশি পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী বৈঠক করে চালের দর নির্ধারণ করে দেন।
সে সময় সরকার ৫০ কেজি ওজনের ভালো মানের এক বস্তা মিনিকেট চালের দাম মিল গেটে ২ হাজার ৫৭৫ টাকা এবং মাঝারি মানের চালের দাম ২ হাজার ১৫০-২ হাজার ২৫০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও পরবর্তীতে তা মানা হয়নি। একইভাবে আলুর দাম বেড়ে গেলে পরপর দুইবার আলুর দর পুনর্নির্ধারণ করে প্রতি কেজি ৩৫ টাকা বেঁধে দেয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু সেই নির্ধারিত দরও মানা হয়নি। তখন প্রতি কেজি আলুর দর ৬০ টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।
গতকাল রাজধানীর শান্তিনগর, নিউমার্কেট ও মহাখালী কাঁচাবাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক বিষয়ক জাতীয় কমিটির এক সভায় খুচরা পর্যায়ে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের বিক্রি মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১১৭ টাকা। খোলা পাম অয়েলের খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয় ১০৯ টাকায়।
যা গতকাল বাজারে ১১০ টাকা লিটার দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। আর পাম সুপারের মূল্য নির্ধারণ করা না হলেও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে তা লিটারে ৫ টাকা বেড়েছে। এছাড়া ১ ও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল নির্ধারিত মূল্যের কাছাকাছি বিক্রি হতে দেখা গেছে। ১ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য ১৩৯ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা ও ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের খুচরা মূল্য ৬৬০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কোম্পানিভেদে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬৬০ থেকে ৬৭০ টাকা।
গতকাল মহাখালী কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, সরকারতো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে তেলের দাম নির্ধারণ করে দিল। কিন্তু এখন যে নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে তেল বিক্রি হচ্ছে—এটা কেন দেখা হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকার নির্ধারিত দর ব্যবসায়ীরা না মানলে তা কেন নির্ধারণ করা হয়? এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা নির্ধারিত দর মানছে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এক মাসের ব্যবধানে গত ১৫ মার্চ ভোজ্য তেলের দাম পুননির্ধারণ করে সরকার। এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোজ্য তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলের দাম বাড়ায় দেশের বাজারেও দাম বাড়াতে হয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
গত প্রায় দুই মাস ধরে দেশে ভোজ্য তেলের বাজার অস্থির। লাগামহীনভাবে বাড়ছে রান্নার অতি প্রয়োজনীয় এই পণ্যটির দাম। গত দুই থেকে আড়াই মাসের ব্যবধানে প্রতি লিটার সয়াবিনে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। যা ভোগান্তিতে ফেলেছে ভোক্তাদের। তাদের অভিযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি এমন অজুহাতে একটি চক্র কারসাজি করছে ভোজ্য তেল নিয়ে।
সম্প্রতি রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম বেশি থাকায় দেশের বাজারে সমন্বয় করা হয়েছে। দাম কমলে আবার সমন্বয় করা হবে।শবেবরাতের আগে বাড়ল মসুর ডাল, আটা, গরুর মাংস, ব্রয়লার মুরগি, দুধ ও চিনির দাম
এদিকে পবিত্র শবেবরাতের আগে দাম বাড়ল বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের। শবেবরাতের এখনো প্রায় দেড় সপ্তাহ বাকি থাকলেও গতকাল বাজারে মসুর ডাল, আটা, গরুর মাংস, ব্রয়লার মুরগি, দুধ ও চিনির দাম বেড়েছে। গতকাল বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, প্যাকেট আটা কেজিতে ১ টাকা বেড়ে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত সপ্তাহেও ৩২ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আর মাঝারি দানা মসুর ডাল এক লাফে কেজিতে ৫ টাকা বেড়েছে। গতকাল বাজারে তা বিক্রি হয় ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি দরে। আর বড় দানা মসুর ডাল ৬৫ থেকে ৭০ টাকা ও ছোট দানা মসুর ডাল ১০০ থেকে ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে গত প্রায় মাসখানেক ধরেই ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়ছে। গতকাল এক দিনেই বাজারে কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায়। এছাড়া দেশি মুরগি কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা ও কক জাতের মুরগি ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম বেড়েছে গরুর মাংসেরও। কেজিতে ২০ টাকা বেড়ে গতকাল বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬০০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিকে শবেবরাতে যে পণ্যগুলোর চাহিদা সবচেয়ে বেশি বাড়ে তার মধ্যে রয়েছে চিনি ও দুধ। গতকাল বাজারে এ দুটি পণ্যের দামও বেড়েছে। চিনির দাম কেজিতে ৩ টাকা বেড়ে ৬৮ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর ডানো ব্র্যান্ডের গুঁড়ো দুধ কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ৬১০ থেকে ৬৩০ টাকা ও মার্কস ১০ টাকা বেড়ে ৫৬০ থেকে ৫৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খবর সারাবেলা / ২০ মার্চ ২০২১ / এমএম