সম্পর্ক
কার্তিকের রাতে আষাঢ়ের বৃষ্টি। ঝড়ছে তো ঝড়ছেই। মনে হচ্ছে, পুরো আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। যে নিজেই এভাবে ঝড়ছে সে আর কার মনের খবর নেবে! নিলে বুঝতে পারত নিসর্গের কান্নার বৃষ্টি। মনে হচ্ছে, পাল্লা দিয়ে কাঁদছে দুজন।
সন্ধ্যায় বাইরে থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাসায় ঢুকে কাপড় ছেড়েই কফির মগ নিয়ে অন্ধকার বারান্দার একপাশে ইজি চেয়ারটায় বসেছে। যেখানে বসে আছে সেখানে কার্নিশ ছুঁয়ে বৃষ্টির ঝাপটা শরীরে এসে একটু একটু করে ভিজিয়েও দিচ্ছে। তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না।
নিসর্গ- আমাকে বিয়ে করবেন?
অমিত- না। আরেকজনকে ভালবাসি…..আরো কি যেন বলেছিল।কিন্তু নিসর্গের কানে ওই না’টাই ঠিকমতো পৌঁছেছে।
নিসর্গ- ঠিক আছে।
জীবনে প্রথম কাউকে নিজের কোনো ইচ্ছের কথা জানালো। কিন্তু এভাবে প্রথম বলেই বোল্ড আউট হতে হবে এতটা ভাবেনি সে। মন খারাপের ধাক্কাটা একটুও বুঝতে না দিয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বলার পর অমিত জানতে চাইল, সে ফোন করলে কথা বলবে কিনা? কষ্ট হবে ভেবেও চিরায়ত বৈশিষ্ট্যের ধারায় সেদিন হ্যাঁ বলেছিল নিসর্গ। কিন্তু নিজের উদ্যোগে হ্যাঁ বলার ফল যেভাবে টের পেয়েছে তা বোঝানোর মতো শব্দ ডিকশনারিতে আছে কি?।
অমিত- ফোন ধরছিলি না কেন? তোকে না বললাম সারিনা থেকে বের হয়ে ফোন দেব।
নিসর্গ- একটু ঘুমাই পড়ছিলাম। তোর বকবকানি শোনার জন্য সারারাত কে জেগে থাকবে?
অমিত- তুই থাকবি। একমাত্র তুই আছিস যে আমার বকবকানি শোনে। জানিস, আমার কিছু ভাল লাগে না। ফেসবুক, মেইল সব জায়গা থেকে আমাকে ব্লক করছে। একটু দেখতেও পারি না। এত জেদ….আমার ওপর জেদ করে এসব করেছে। কিচ্ছু ভাল লাগে না রে। কোথাও চলে যাব তারও উপায় নেই। ঠিক আছে ঘুমা। বাসায় ঢুকব এখন।
আপা, আপা, আপা। মিনির প্রায় চিৎকারের মতো ডাকে হুশ ফিরল নিসর্গের। কহন থিক্যা ডাকতাছি। ভিজ্জা শ্যাষ হয়া গ্যাছেন। এহনকার পানি গায়ে পড়লে আর বাঁচন আছে? তহনও বৃষ্টি নিয়া বাসায় আসছেন। হায় খোদা, কফিতে তো মনে হয় মুখই দেন নাই! কটা বাজেরে? সাড়ে ১০টা।
শব্দটা কোত্থেকে আসছে? ওহ বালিশের নিচ থেকে, রাত প্রায় আড়াইটা, এতরাতে কে ফোন দেয়? কারো কোনো বিপদ হলো না তো?
নিসর্গ- হ্যালো কে? তুই? এতো রাতে? কি হয়েছে?
অমিত- আমি কোথায় এটা জানিস না তুই? মাত্র কাজ শেষ করলাম।
নিসর্গ- তো ঘুমিয়ে পড়তি। ঘুম না হলে সকালে উঠতে পারবি? এমন তো না যে, কাল সারাদিন ঘুমাতে পারবি।
অমিত- তোকে বলছি, আমি ঘুমাবো? এখন তোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে ঘুমাব।
নিসর্গ- হুম তা ঠিক, আমার কথা ভাল লাগবে কেন? আমাকে না জ্বালালে তোর ভাত হজম হবে কেন!
অমিত- কথা বলব, ফোন করব, জ্বালাব। তুই ফোন ধরবি।
নিসর্গ- আর পারবো না। গার্ল ফ্রেন্ডকে খুঁজে বের কর। না হলে বিয়ে কর। যা ইচ্ছা তাই কর। আমাকে শান্তি দে।. . . .চল ঘুমাই। আযান হবে এখন। হুম। ফোন রাখ। না রাখবো না। আরো কথা বলবো। অমিত. .অমিত. .অমিত. .।
সেবার অফিসের কাজে অনেকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে ছিল অমিত। যথারীতি প্রতিরাতের রুটিন একটাই। ওদের মধ্যে কি আদৌ কোনো কথা হতো? একজন বকে যেত, আরেকজন শুনে যেত! নাকি দুজনেই অভ্যাসের দাস হয়ে গিয়েছিল?
অমিত- আসবি একটু?
নিসর্গ- কেন? কি হল আবার?
অমিত- আয় না। তোর সঙ্গে সামনাসামনি বসে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ আয় একবার। একটু কথা বলেই বাসায় যাব।. .আসবি না?
নিসর্গ- আজ কি অনেক বেশি খাইছিস? পাগলামো করিস না। বাসায় যা।
অমিত- তোর সঙ্গে দেখা না করে বাসায় যাব না।
নিসর্গ- যাস না!…….হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো অমিত!
মিনি, মাথাব্যথার বামটা দিয়ে যা।
অমিত- বাসায় তো রীতিমত অত্যাচার শুরু হয়ে গেছে। বিয়ে নিয়ে পাগল বানায়ে ফেলল। রাতে খেতে বসলেই আম্মা আমার পাশে বসে শুরু করে প্যাচাল। আর ইদানিং নতুন জিনিস শুরু হইছে, সন্ধ্যা থেকেই ফোন করে বলে কই আছি। আগে এমন করত না।
নিসর্গ- ভাল তো বিয়ে করে ফেল।
অমিত- বা. .।
আপা, মেলা বাজে, কহন খাইবেন? আপনি খাইয়্যা লইলে সব গোছায়া শুইয়া পড়ুম। তুই খাইছিস? হ আপনের দেরি দেইখ্যা খাইয়া ফালাইছি। আচ্ছা, খুব ভাল হইছে, আমার খাবার ফ্রিজে রেখে তুই শুয়ে পড়। আপনে খাইবেন না? না খাইলে শরীল খারাপ হইব তো! কয়দিন থিক্যা দেখতাছি মন মরা হয়া থাকেন। এমন তো আছিলেন না আপা। কিছু হইছে? আমারে কওন যাইব? সন্ধ্যায় বাইরে খাইছি। এখন আর ভাল্লাগছে না। তুই শুয়ে পর।
অমিত- চল কোথাও ঘুরতে যাই। চেরাপুঞ্জি যাবি? এখন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। ভাল্লাগবে।
নিসর্গ- হুম গেলাম। তারপর?
অমিত- ধর আমরা একটা পাহাড়ে উঠলাম। তারপর সন্ধ্যা হল, কিন্তু ফিরলাম না।
নিসর্গ- হুম, তারপর?
অমিত- ওখানেই থাকব। সারারাত রোমান্স করব!
নিসর্গ- আমার তো পা ব্যাথা। কোলে নিয়ে উঠাবি একটু?
আপা, আপা। আপনি কানতাছেন? কই না তো? না মনে হল, কান্নার শব্দ পাইলাম। কি শুনিস না শুনিস। যা শুয়ে পর।
অমিত- আর ঠেকানো গেল না। বাসা থেকে মেয়ে দেখে বিয়ের ডেট ঠিক করে ফেলছে।
নিসর্গ- তুই মেয়ে দেখছিস? কেমন দেখতে?
অমিত- দেখার কি আছে, যা ইচ্ছা করুক।
নিসর্গ- ছবিও দেখিস নি?
অমিত- দেখছি, আছে আর কি!
নিসর্গ- বাহ খুব ভাল। শেষ পর্যন্ত বিয়ে করছিস তাহলে। কনগ্রাচুলেশনস।
অমিত- নিসর্গ. . .অ্যাই নিসর্গ. . কি হল চুপ করে আছিস কেন?
নিসর্গ- কিছু না। নেটওয়ার্ক মনে হয় ডিস্টার্ব করছিল, তোর কথা শুনতে পাচ্ছিলাম না।
নাহ, অলৌকিক কিছুই ঘটল না। তাহলে লোকে যে বলে? সেটা শুধুই গল্প? নামহীন, অস্পষ্ট এই সম্পর্কে অমিতের কোনো দোষ নেই। কোনো আশ্বাস দেয়নি, কিছু লুকায়নি সে। কিন্তু অমিত কিছুই বুঝল না?
একতরফা কিছুই আগায় না, শুধু ভালবেসে যাওয়া যায়। তাই, ফোনের এপাশে কষ্ট, কান্না গিলে ফেলে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে গেছে। অমিতকে ভাল রাখার জন্য এই বিয়েটাও নিসর্গের চেষ্টার ফল। ওর গার্ল ফ্রেন্ডকে আনতে যে সময় দরকার ছিল সেটা পায়নি। তার আগেই অবিশ্বাস্যভাবে অমিত অন্য একটি মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হল।
অমিত- কি করছিলি? কখন থেকে ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছি। কথা বলিস না কেন?
নিসর্গ- শুনছি বল।
অমিত- আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, তুই আমার সঙ্গে আর কথা বলবি না, ফোন ধরবি না। বল না, সারাজীবন আমার বন্ধু হয়ে থাকবি?
উফ! বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচরে দলা পেকে বের হতে গিয়েও হচ্ছে না। দমটা কি বের হয়ে যাবে? আর সহ্য হচ্ছে না। বাইরের চলমান বৃষ্টির কাছে অদৃশ্য রক্তক্ষরণটা জমা দেবে নাকি নিসর্গ? পানির তোড়ে যদি একটু শান্তি পাওয়া যেত!
খবর সারাবেলা / ১০ ডিসেম্বর ২০২০/এমএম