শেখ রাসেলের জন্মদিনের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী: কঠোর সাজা হবে শিশু নির্যাতনকারীদের
আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা চাই না আর কোনো শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হোক। যারা শিশু নির্যাতন বা শিশু হত্যা করবে তাদের কঠোর থেকে কঠোরতর সাজা পেতে হবে, অবশ্যই পেতে হবে। শিশুদের প্রতি কোনো অন্যায়-অবিচার বরদাশত করা হবে না।
শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মদিন উপলক্ষে শুক্রবার বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। আয়োজক সংগঠনের চেয়ারম্যান রকিবুল রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে সংগঠনের মহাসচিব মাহমুদ উদ সামাদ এমপি, উপদেষ্টা তরফদার রুহুল আমিন, সাংগঠনিক সচিব একেএম শহীদ উল্যা প্রমুখ বক্তব্য দেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সংগঠনের শিশুসদস্য আফিয়া।
অনুষ্ঠানে প্রিয় ছোট ভাই শেখ রাসেলের স্মৃতিচারণ করেন বড় বোন শেখ হাসিনা। তিনি বারবার অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। এ সময় পুরো সভাস্থল নীরব নিঃস্তব্ধ হয়ে পড়ে। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী কান্নায় ভেঙে পড়লে সম্মেলনস্থলে উপস্থিত শত শত শিশু-কিশোরও নিজেদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি।
একাত্তর ও পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার হবে না- এমন আইন করে খুনিদের বিচারের হাত থেকে মুক্ত করে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। আমি যখন দেশে ফিরে আসি তখন মামলা করতে চেয়েছিলাম। আমাকে বলা হল, মামলা করা যাবে না। অর্থাৎ আমি আমার মায়ের হত্যার বিচার পাব না, আমার ভাইয়ের হত্যার বিচার পাব না। আমার বাবার হত্যার বিচার পাব না।
তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে আমরা শিশুদের ওপর অমানবিক অত্যাচার দেখছি। কী আশ্চর্য ঘটনা, অদ্ভুত ব্যাপার। বাবা হয়ে সন্তানকে হত্যা করে অন্যকে ফাঁসানোর জন্য। কী বিকৃত মানসিকতা মানুষের মাঝে। সেই সময় যদি শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার করা হতো তাহলে অন্তত মানুষের ভেতরে একটা ভয় থাকত। এ ধরনের মানসিকতা গড়ে উঠত না।
তিনি বলেন, আমরা চাই আর কোনো শিশু যেন এ ধরনের হত্যার শিকার না হয়। প্রত্যেকটা শিশু যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। অন্যায়-অবিচার কখনোই বরদাশত করা হবে না। যারা শিশু নির্যাতন বা শিশু হত্যা করবে তাদের কঠোর থেকে কঠোরতর সাজা অবশ্যই পেতে হবে।
শিশুদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সততা নিয়ে তোমাদের বড় হতে হবে। সততা থাকলে কারোর কাছে মাথানত করতে হয় না। সততার মধ্যে এক অন্যরকম শক্তি থাকে। তাই সব ধরনের অন্যায় দিক যেমন: জঙ্গি, সন্ত্রাস, মাদক থেকে দূরে থাকতে হবে।
শেখ হাসিনা বলেন, রাসেল আমাদের পরিবারের সদস্যদের সবচেয়ে কনিষ্ঠ। পিতা বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষের প্রতি দরদি মন ছিল শেখ রাসেলেরও। বেঁচে থাকলে হয়তো দেশের জন্য অনেক কিছু করত। মাঝে মাঝে মনে হয় ৫৪ বছর বয়সে দেখতে রাসেল কেমন হতো?
বলতে বলতে অশ্রুসিক্ত চোখে থেমে যান প্রধানমন্ত্রী। কিছুটা সময় বিরতি নিয়ে চোখ মুছে নেন। তিনি বলেন, রাসেলের জন্ম হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। যে মুহূর্তে রাসেল জন্মায় তখন আব্বা খুব ব্যস্ত। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, ফাতেমা জিন্নাহ প্রার্থী। তিনি সেই নির্বাচনে প্রচার কাজে চট্টগ্রামে ছিলেন। অত্যন্ত ব্যস্ত ছিলেন। রাসেলের জন্ম হওয়ার পর আমরা তাকে খবর দেই। তিনি বলেন, আমরা চার ভাইবোন উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ছিলাম এই ছোট্ট শিশুটির জন্ম মুহূর্তটায়। তাকে লালন-পালন আমরাই করেছি। জাতির জনক ’৬৭ সালে যখন কারাগারে গেলেন রাসেলের বয়স তখন ২ বছরও হয়নি। তখনই সে বাবার স্নেহবঞ্চিত হল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা কারাগারে যেতাম আব্বার সঙ্গে দেখা করতে। রাসেল কিছুতেই আসতে চাইত না। সে আব্বাকে ছাড়া আসবে না। আব্বাকে নিয়ে ঘরে ফিরবে। সেই সময় আব্বা বলতে বাধ্য হলেন, এটা আমার বাড়ি। আমি আমার বাড়িতে থাকি। তুমি তোমার মায়ের বাড়িতে যাও। তখনও সে ভালো করে কথাও বলতে পারে না। তারপর সে প্রচণ্ড কান্নাকাটি করত। তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে আসতে হতো।
তিনি বলেন, যেদিন আমরা জেলখানায় দেখা করতে যেতাম, সেদিন রাসেল খুব অস্থির থাকত। ঘুমাতে চাইত না, খেতে চাইত না। অনেক সময় মধ্যরাতে উঠে বসে থাকত, আমাদের সবাইকে ডাকত। আমরা সব ভাইবোন গিয়ে ওর কাছে বসতাম। ‘ও’ কিছু বলতে পারছে না। মনের ব্যথাটা জানাতে পারছে না। কিন্তু ওর বেদনাটা আমরা বুঝতে পারতাম।
শেখ হাসিনা বলেন, এভাবেই রাসেল বড় হয়ে ওঠে। আব্বা ডাকা শুরু করে। অনেক সময় মাকে সে আব্বা বলে ডাকত। মা-ই বলতেন আমি তোমার আব্বা। আমাকে আব্বা বলে ডাক। কারাগারে গিয়ে একবার সে আব্বার মুখের দিকে তাকাত, আব্বা বলে ডাকত। আবার মায়ের দিকে তাকাত। তখন মা বলেছিলেন, ‘ও’ যেহেতু আব্বা আব্বা বলে কান্নাকাটি করে তাই আমি বলেছি আমাকেই আব্বা ডাকতে। সেই জন্যই রাসেল জেলখানায় গিয়ে একবার আব্বার দিকে, আরেকবার মায়ের দিকে তাকাত। একটা ছোট্ট শিশু পিতার স্নেহবঞ্চিত ছিল। আমরা তো বঞ্চিত ছিলামই।
একাত্তরের যুদ্ধচলাকালীন সময়ের স্মৃতি বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাসেল খুব চাপা স্বভাবের ছিল, সহসা কাউকে কিছু বলত না। ওর চোখে সব সময় পানি। যদি কখন বলতাম তোমার চোখে পানি কেন? বলত চোখে কী যেন পড়েছে। ওইটুকু ছোট বাচ্চা, সে তার নিজের মনের ব্যথাটা পর্যন্ত কীভাবে লুকিয়ে রাখত আমার ভাবতেও অবাক লাগে। আমার ছোট ভাই কামাল মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে গেছে। জামালও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চলে গেছে। যুদ্ধের সময় যখন আক্রমণ হতো, বিশেষ করে, যখন এয়ার রেইড হতো। রাসেল সব সময় পকেটে একটু তুলা রাখত। নিজের কানে দিত, ছোট্ট জয়ের কানে দিয়ে দিত। যেন ওই আওয়াজে জয়ের কোনো ক্ষতি না হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, রাসেল সব সময় খুব খেয়াল রাখত জয়ের (সজীব ওয়াজেদ জয়) প্রতি। স্বাধীনতার পর আব্বা যখন ফিরে এলেন, আপনারা দেখবেন- সব সময় আব্বার পাশে রাসেল। রাসেল যেন আব্বাকে ছাড়তে চাইত না। রাসেলের খুব শখ ছিল বড় হয়ে আর্মি অফিসার হবে। সেইভাবে সে কিন্তু নিজেকেও তৈরি করত। ছোট ছোট গরিব শিশুর প্রতি তার দরদ ছিল। যখন গ্রামে যেত তখন অনেক শিশুকে জড়ো করত। সে কাঠের বন্দুক বানাত। ওই শিশুদের জন্য মাকে বলত যে কাপড়-চোপড় কিনে দিতে হবে। মা ঠিকই কাপড়-চোপড় কিনে দিতেন। ওদেরকে নিয়ে সে প্যারেড করাত। প্যারেড করানো শেষে তাদের খাবার-দাবার দিত। আর সবাইকে ছোট ছোট এক টাকার নোটের বান্ডিল থেকে একটা করে টাকা দিত। এটা সে করবেই। তিনি বলেন, ১৫ আগস্টের ছয় বছর পর যখন দেশে আসি, যখন টুঙ্গিপাড়া যাই সেখানে একটা আলমারি ছিল। সেই আলমারির ভেতরে দেখি অনেকগুলো ছোট ছোট শিশুর জামা তখনও পড়ে আছে। আমি জানতাম যে এইগুলো রাসেল ওই গ্রামের গরিব শিশুদের মাঝে বিতরণ করত। তাদের আর্থিক সহায়তা দিত। ওর ভেতরে এই যে একটা দরদি মন ছিল। হয়তো বেঁচে থাকলে এ দেশের জন্য অনেক কিছুই করতে পারত। আজ মাঝে মাঝে মনে হয় ৫৪ বছর বয়স পূর্ণ করেছে।
তিনি বলেন, আমি কোলেপিঠে করেই ওকে বড় করছিলাম। আমাদের অতি আদরের ছিল রাসেল। কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেট ওকে বাঁচতে দেয়নি। আজ রাসেল আমাদের মাঝে নেই। আমি আমার রাসেলকে হারিয়েছি। কিন্তু লাখো রাসেলকে পেয়েছি। আজকের এই মেধাবী শিশুরাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শিশুদের মানবিক মানুষ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তোমাদের পাশে দরিদ্র ও প্রতিবন্ধী শিশু দেখলে তাদের অবহেলা করো না। কারণ তারাও তো তোমাদের মতোই মানুষ। এতে তাদের তো কোনো দোষ নেই।
তিনি বলেন, কখনোই নিজেদের ছোট মনে করবে না। কারও সুন্দর জামাকাপড় আছে, গাড়ি আছে, তোমার নেই, এটা ভাববে না। তোমাদের প্রত্যেকের ভেতরে সুপ্ত প্রতিভা আছে। সেটাকে কাজে লাগিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নেবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শিশুরা যাতে আধুনিকমনস্ক হয়ে গড়ে উঠতে পারে সে জন্য সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রত্যেকটি শিশুর জীবন যেন অর্থবহ হয়, আমরা সে ব্যবস্থা নিয়েছি। শিশুদের যাতে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে না হয় সেই ব্যবস্থা নিয়েছি। ঝরে পড়া কিংবা প্রতিবন্ধীদের জন্যও নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।
বক্তব্যের আগে প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশু-কিশোরদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এরপর দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চের সামনের আসনে বসে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা দেখেন।
খবর সারাবেলা/১৯/ অক্টোবর ২০১৯ /এসএম