মহামারিতে বিপর্যস্ত শিক্ষা ঘুরে দাঁড়ানোর উপায়

February 3, 2021

করোনা মহামারির ভয়াবহ বিস্তার শুরু হওয়ার এক বছর হতে চলল। এই এক বছরে দরিদ্র থেকে সম্পদশালী সব দেশ তাদের অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত হতে দেখেছে, স্বাস্থ্যচিত্রের বিনাশ এবং শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জনজীবনের বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করেছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর বার্ষিক প্রবৃদ্ধি শূন্যের নিচেও কয়েক শতাংশ নেমে গেছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান অনেকটাই ভালো। ২০২০ সালে আমরা ৮-৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করলেও সেটি তিন শতাংশের কাছাকাছি থাকতে পেরেছে।

এজন্য প্রথমেই আমাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত প্রবাসী শ্রমিক, পোশাক ও কল-কারখানায় কর্মরত শ্রমিক, কৃষক এবং খেটে খাওয়া মানুষদের, যাদের শ্রমের ফসল দুর্যোগের সময় এদেশ ঘরে তুলতে পেরেছে। আমরা যে আরও অনেককে মহামারির শিকার হতে দেখিনি, তা নিশ্চিত করেছেন আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা- চিকিৎসক, সেবক থেকে নিয়ে চিকিৎসা-প্রযুক্তিবিদরা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন আমাদের বিপর্যস্ত করেও আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ও উদ্যমটা কেড়ে নিতে পারে না, এক্ষেত্রে আমরা তা দেখেছি। এজন্য এই সম্মুখযোদ্ধাদের আমাদের অভিবাদন।

করোনা মহামারি অবশ্য এক দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত রেখে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাচিত্রে। গত বছর মার্চে যখন এর অদৃশ্য কিন্তু মারাত্মক উপস্থিতি আমাদের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে, পরীক্ষা পিছিয়ে দিতে বা বাতিল করতে এবং বিকল্প শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি উদ্ভাবনে বাধ্য করল, তখন বোঝা গিয়েছিল মহামারি শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান বোঝার ওপর শাকের একটি আঁটি শুধু নয়, সমান আরেকটি বোঝাও চাপবে। সেই যে বন্ধ হল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো- এক অবাস্তব অনিশ্চয়তায়- এখনো তাদের দরজা খোলার সময় আসেনি। মহামারি শেষ না হলে খোলাটাও অনুচিত হবে, তাও আমাদের মানতে হবে।

মহামারি শিক্ষাচিত্রে যে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, তার কয়েকটি দিক এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমত, সরাসরি, শ্রেণিকক্ষভিত্তিক শিক্ষাদান বন্ধ হয়েছে। এর ফলে অনলাইন শিক্ষাদান শুরু হয়েছে, কিন্তু তা শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যায়নি। শিক্ষার্থীদের এক বড় অংশ এর বাইরে রয়ে গেছে। এর ফলে এক ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, যার একটি প্রকাশকে আমরা ডিজিটাল বৈষম্য বলে বর্ণনা করতে পারি। অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের ছকবাঁধা, মুখস্থনির্ভর এবং শিক্ষক-কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, মহামারিতে অনেক পরিবার উপার্জন হারিয়েছে, অনেক পরিবারে মৃত্য এবং অসুস্থতা আঘাত করেছে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। গ্রামের কিছু শিক্ষার্থী কায়িক শ্রমে পরিবারের দুর্গতি মোচনের চেষ্টা করেছে- তাদের সবাই যে পড়াশোনায় ফিরবে, সেই নিশ্চয়তা নেই। মহামারির শুরুতে এ বিষয়টি প্রকট ছিল। কিন্তু অর্থনীতি উঠে দাঁড়ানোতে এ সংকটের কিছুটা সমাধান হয়েছে।

তৃতীয়ত, বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, অনেক শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন। তাদের সহায়তায় না সরকারি, না বেসরকারি পর্যায়ে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

চতুর্থত, সরাসরি শিক্ষার পরিবেশ থেকে দূরে, একেবারে ভিন্ন, বন্ধুবান্ধবহীন- বলতে গেলে অবাস্তব- এক অবস্থায় নিজেদের সামর্থ্যরে ওপর পড়াশোনা করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা শুধু তাদের সক্ষমতাকে যে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে পারছে না তা নয়, এক ধরনের মনোস্তাত্ত্বিক সমস্যাতেও তারা পড়ছে। যেসব শিক্ষার্থী অনলাইন শিখনে অংশগ্রহণ করতে পারছে না, তাদের মনে বঞ্চনার ক্ষোভ জন্মাচ্ছে।

পঞ্চমত, পরীক্ষা না দিতে পারা, পরীক্ষা ছাড়াই উপরের ক্লাসে উঠে যাওয়া- এসব বিষয়ও পরীক্ষার্থীদের ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বিপর্যয়ের আরও দিক আছে- যেমন সচ্ছল পরিবারের অনেক সন্তান ইন্টারনেটের নানা অন্ধকার অলিগলিতে ঢুবে পড়ছে; এক মনোস্তত্ত্ববিদের মতে মাদকের দিকেও অনেক শিক্ষার্থী ঝুঁকছে, শিক্ষার্থীদের পাঠের অভ্যাস কমে যাচ্ছে ইত্যাদি। তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ দুর্যোগের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতাটা অনেক আগেই রপ্ত করেছে। ঝড়ে একটি ঘর ভেঙে গেলে তার জায়গায় নতুন একটি ঘর তারা তোলে। একাত্তরেও এক বছর আমরা প্রায় শিক্ষা-বঞ্চিতই ছিলাম। কিন্তু বিজয়ের পর থেকেই আমরা নতুন উদ্যমে শুরু করেছি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিপর্যস্ত শিক্ষা ব্যবস্থাকে শুধু মেরামত নয়, খোল নলচে পাল্টে একে এক শক্তির এবং গতিশীলতার অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ কিছু কাজ করেছিলেন- তার কিছু ভৌত, যেমন ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সারিয়েছেন, নতুন বেশ কিছু তৈরি করেছেন। কিন্তু দুটি আদর্শগত অবস্থান চিহ্নিত করে তিনি এগিয়েছেন। এর একটি, নতুন দেশের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ, গণমুখী, বৈপ্লবিক শিক্ষানীতি প্রণয়নে তিনি সফল হয়েছেন। একজন বিজ্ঞানী, যিনি সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতেন, ড. কুদরত-ই-খোদা ছিলেন এই শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্বে। এটি যদি কার্যকর করা যেত, আজ আমরা শিক্ষায় অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। বঙ্গবন্ধুর আরেকটি অবস্থান ছিল শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো। সেই ১৯৭০-এর নির্বাচনের আগে থেকেই তিনি বলে আসছিলেন, শিক্ষায় জিডিপির অন্তত ৪ শতাংশের বিনিয়োগ দরকার। এ ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পূর্ণ সায় ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ঘাতকেরা এই সম্ভাবনাটিকেও হত্যা করে।

মহামারির বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এবং বঙ্গবন্ধুর এ দুটি আদর্শিক অবস্থান থেকেই আমাদের শুরু করতে হবে। আমাদের একথা স্বীকার করেই এগুতে হবে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্পদ সীমিত এবং কৃষি, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাতে এই সীমিত সম্পদ থেকে বরাদ্দের জোগান দিতে হয়। এ সত্ত্বেও শিক্ষাকে সমাজ তার অগ্রাধিকারের শীর্ষে রেখেছে বলে এর বিস্তার বেড়েছে এবং শিক্ষার সুযোগ বঞ্চিত শিশু-কিশোরের সংখ্যা এখন আর হতাশাজনক নয়। তারপরও বঙ্গবন্ধুর আরেকটি কথা এখানে উদ্ধৃতি দেয়া যায়। তিনি বলেছিলেন, শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। আমরা পদ্মা সেতু, নানা মেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ করে দেশের উন্নয়ন করছি এবং প্রশংসিত হচ্ছি। কিন্তু একশ-দেড়শ বছর পর্যন্ত এই প্রকল্পগুলোর আয়ু। অথচ শিক্ষায় বিনিয়োগ কখনো তারিখ-সম্বলিত নয়। বরং প্রতি বছর এ থেকে পাওয়া লাভের পরিমাণ বাড়তে থাকে।

শিক্ষায় বরাদ্দ যদি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে আমরা জিডিপির ৬ শতাংশে এবং ২০৪০ সালে ৮ শতাংশে পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে আর এক প্রজন্মেই বাংলাদেশে মেধাবিকাশে, মননশীলতার চর্চায়ু, বুদ্ধি, যুক্তি এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিপূর্ণ ব্যবহারে এক নীরব বিপ্লব ঘটে যাবে। একে শক্তি জোগাবে একটি যুগোপযোগী, বিজ্ঞানমনস্ক, প্রাগ্রসর ও ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষানীতি, যা শিক্ষাকে একটি মূল ধারায় স্থিত করে ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, পরিবেশ, প্রযুক্তি, নৈতিকতা ও সৌন্দর্যজ্ঞান, সামাজিক সম্পর্ক, জেন্ডার ও নানা ভিন্নতার প্রতি সংবেদনশীলতা, দায়িত্বশীলতা ও চরিত্রের অখণ্ডতা, আইন ও সুবিচার, জনস্বাস্থ্য- এসব নানা বিষয়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জ্ঞান ও চর্চার সমাবেশ ঘটাবে।

এটি সম্ভব। এ দেশে তরুণরা একাত্তরে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিল। এই সমতল দেশের তরুণরা- যারা জীবনে হয়তো একটি এক হাজার ফুট উঁচু পাহাড় দেখেনি, তুষারাচ্ছাদিত পাহাড় তো দূরের কথা। তারা এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছে।

মোটা দাগে শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাগুলো হল-

তিন ধারায় বিভক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা, মানের ঘাটতি, শিখন ও শিক্ষণে দুর্বলতা, মেধাবী শিক্ষকদের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত এবং গ্রহণযোগ্য মানের ভৌত কাঠামোও সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, গতিশীল এবং জীবনমুখী পাঠক্রমের অনুপস্থিতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত ব্যবহারে তথ্যপ্রযুক্তির অত্যন্ত সীমিত প্রয়োগ, খেলাধুলা ও জীবনচর্চার সীমিত সুযোগ, ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষায় অপূর্ণতা, অসচ্ছল ও প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগ-সুবিধার অভাব ও তাদের ঝরে পড়া (এক্ষেত্রে অনেক ছেলে-শিশুর শ্রমে নিযুক্ত হয়ে যাওয়া এবং মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়ার সমস্যাটি বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করে), শিক্ষায় ব্যক্তিখাতের অংশগ্রহণে গত দুই-তিন দশকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন, কোচিং বাণিজ্যের ভয়াবহ বিস্তার, নোট বই-গাইড বইয়ের ভীতিকর আগ্রাসন, শহরগুলোতে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক পর্যায়ে প্রি-ক্যাডেট স্কুল ধরনের নিম্নমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণহীন বিস্তার। সমস্যা আরও আছে, তবে সেগুলোর উল্লেখের প্রয়োজন নেই। বলা যায়, একটি সমস্যা আরেকটি সমস্যার জন্ম দেয়। শিক্ষা নিয়ে দর্শনের ও সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনার অভাব থাকলে সমস্যা বাড়তে থাকে। যেমন, ২০১০ সালে গৃহীত কিন্তু উপেক্ষিত শিক্ষানীতিতে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে সমাপনী পরীক্ষা নেয়ার কোনো উল্লেখ নেই। কিন্তু এখন মহা আড়ম্বরে এ দুই নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নেয়া হয়। এর ফলে মুখস্থনির্ভরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে এবং গ্রাম-পর্যায়ে কোচিং বাণিজ্য সম্প্রারিত হয়েছে। আমার ধারণা, এ দুই পরীক্ষা চালু করা ও এদের টিকিয়ে রাখার পেছনে কোচিং বাণিজ্যের এবং নোট বই-গাইড বইয়ের সিন্ডিকেটগুলোর বড় ভূমিকা আছে। কোচিং বাণিজ্যের বিস্তার ঘটলে অনেক শিক্ষক এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। ফলে অনেকেই শ্রেণিকক্ষে মন দিয়ে, সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে পড়াতে পারেন না (অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা করেন না, যেহেতু শিক্ষার্থীদের কোচিং-এ উৎসাহিত করার কাজটিও তারা করেন)। শিক্ষকরা কেন কোচিং বাণিজ্যে যুক্ত হবেন? কারণ তারা যা বেতন-ভাতা পান, তা এতই অপ্রতুল যে তা দিয়ে সম্মানজনক জীবনযাপন (সচ্ছল না হলেও) অসম্ভব। কান টানলে মাথা আসে বলে বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে এর উপস্থিতি আমরা প্রতিদিন দেখতে পাই।

শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রয়োজন, একটি সুষ্ঠু দর্শন ও দিকনির্দেশনা-দলিলের প্রয়োজন এবং আরও প্রয়োজন ব্যবস্থাপনা দক্ষতার। এ ব্যবস্থাপনা হবে বহুমুখী : প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা কার্যক্রম, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশ, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা-সহায়ক কার্যক্রমসহ অন্যান্য অনেক বিষয়সহ তহবিল ব্যবস্থাপনা। এখানেও এই তিন ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ একটি যোগাযোগ থেকে যাবে। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে বিশ্বমানের শিক্ষার অধিষ্ঠান চাই, তাহলে একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রয়োজন হবে, যা হবে ভবিষৎমুখী। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব যে আসন্ন, সেই বিষয়টি মাথায় রেখে এবং এজন্য জ্ঞান ও দক্ষতার অঞ্চলে কী কী নতুন দাবি তৈরি হবে, সেগুলো নজরে রেখে আমাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে ভিত্তি মেনে এবং শিক্ষার্থীদের মেধার সর্বোচ্চ ঠিকানাকে লক্ষ্য রেখে এই নীতিটি প্রণীত হবে। এই শিক্ষানীতি যে বিনিয়োগ দাবি করবে, রাষ্ট্রকে তা দিতে তৈরি থাকতে হবে। বিনিয়োগ না হলে বাকি সব পরিকল্পনা শুধু কল্পনা হয়েই থাকবে।

একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি হলে, তহবিলের জোগান হলে প্রায় সব কটি বর্তমান সমস্যার সমাধান হবে। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সব সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে, মেধাবী শিক্ষকের সমাবেশ ঘটানো যাবে, সহ-শিক্ষা কার্যক্রম জীবন ঘনিষ্ঠ করা যাবে- যেগুলোর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধাবিকাশে সহায়তা করার পাশাপাশি সংস্কৃতি, খেলাধুলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো যাবে। কিন্তু একটি আদর্শিক অবস্থানে শিক্ষাব্যবস্থা খুব সহজে বা দ্রুত পৌঁছে যাবে না। এজন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও উন্নত ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার- তা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা সরকারি প্রশাসনে অথবা কর্পোরেট দুনিয়া, যেখানেই হোক- কয়েকটি সুফল সহজেই এবং দ্রুতই পাওয়া যায়, যা ক্রমাগত চর্চায় একটা সংস্কৃতিতেই দাঁড়িয়ে যায়। এগুলোর মধ্যে আছে দুর্নীতির বিস্তার রোধ এবং সুনীতি চর্চার প্রসার (আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনাতে দুর্নীতি প্রবলভাবে ঢুকে পড়েছে, কাগজে দেখেছি, শিক্ষা বিভাগটি দুর্নীতিতে সরকারি অনেক বিভাগের ওপর অবস্থান নিয়েছে), সময়ানুবর্তিতা, দক্ষতার উন্নয়ন, ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দায়বদ্ধতা, সততা ও স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সেবার মনোবৃত্তি ইত্যাদি। শিক্ষা যে একটি ব্যবসায় পরিণত হয়েছে, তা তখন অনেকটাই নিয়মবদ্ধ হবে, যেহেতু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে কিন্তু তাদের দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হলে তারা প্রকৃতই সমাজের প্রয়োজনে অর্থের বিনিয়োগ করবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও এর নিয়ন্ত্রণও তখন শিথিল হতে হতে অপসারিত হবে।

এই সম্ভাবনাটি কোনো স্বপ্ন নয়, এটি বাস্তবে অনেক দেশেই ঘটছে। আমরাও নিশ্চয় পারব- কারণ দুটি বিষয় আমাদের পক্ষে যাবে। প্রথমত, শিক্ষাকে- এবং মেয়েদের শিক্ষাকে- আমাদের সমাজ প্রকৃত অগ্রাধিকারের বিষয় হিসাবে দেখছে এবং শিক্ষা নিয়ে সমাজে একটি গতিশীল আলোচনা সব সময় চলছে। যদি রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান, সমাজ, ব্যক্তি- সবার সদিচ্ছার সমাবেশ ঘটে, আমাদের বর্তমান সমস্যাগুলোর অবশ্যই নিরসন হবে।

একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দেশটি তার বিনিয়োগের প্রধান ক্ষেত্রটি নিয়ে নিশ্চয় সর্বোচ্চ সক্রিয়তা অবশ্যই দেখাবে, যদি অবস্থানগত পরিবর্তনটির সূচনা আমরা করতে পারি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ

খবর সারাবেলা / ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১ / এমএম