ভবিষ্যৎ এখন এশিয়ার হাতে
২০০০ সালে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ আসত এশিয়া থেকে। এখন ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জিডিপির ৫০ শতাংশের বেশি আসবে এই মহাদেশ থেকে। বৈশ্বিক ভোগের ৪০ শতাংশও হবে এই অঞ্চলে। শুধু অর্থনৈতিক সূচকেই নয়, মানুষের আয়ু বৃদ্ধি থেকে শুরু করে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধিতেও এশিয়া বেশ এগিয়ে গেছে।
সম্প্রতি ম্যাককিনসে গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের ‘এশিয়া’স ফিউচার ইজ নাউ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, এশিয়া কত দ্রুত উঠে আসবে, প্রশ্ন সেটা নয়, এশিয়া কীভাবে পুরো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে, সেটাই এখন প্রশ্ন।
এশিয়ার এই উত্থানে যে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমা থেকে বেরিয়ে এসেছেন, তা–ই নয়, প্রতিটি স্তরের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। নগরায়ণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করেছে এবং মানুষের জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার দ্বার খুলে দিয়েছে। কিন্তু এই মহাদেশে এখনো বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষের বসবাস।
প্রতিবেদনে বাণিজ্য, করপোরেটদের উত্থান, ডিজিটাল উদ্ভাবন ও ভোক্তা—এই চার নিরিখে এশিয়ার উত্থানের পথনকশা চিত্রিত হয়েছে। প্রতিবেদনের বড় অংশজুড়ে স্বাভাবিকভাবেই চীন ও ভারতের প্রসঙ্গ এসেছে। তার সঙ্গে আছে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশের প্রসঙ্গ। বাংলাদেশের কথাও প্রসঙ্গক্রমে এসেছে।
বাণিজ্য
এত দিন বিশ্বের কারখানা হিসেবে চীন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। তাদের বাণিজ্যের বড় একটি অংশ ছিল শ্রমঘন শিল্পপণ্য। কিন্তু চীন এখন উচ্চ প্রযুক্তির পণ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সেই জায়গায় চলে আসছে এখন ভিয়েতনাম। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিনিয়োগ যাচ্ছে দেশটিতে। এ ছাড়া প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত এক দশকে বাংলাদেশের শ্রমঘন পণ্য রপ্তানি বেড়েছে ৭ শতাংশ হারে। চীনের ছেড়ে দেওয়া জায়গা নেওয়ার সুযোগ বাংলাদেশের আছে। তবে শুধু সস্তা শ্রম নয়, আগামী দিনে প্রতিযোগিতা করতে অবকাঠামো, দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।
এশীয় দেশগুলোর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায় এই মহাদেশের রপ্তানি অনেকটা কমেছে। ২০০৭ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে চীনের রপ্তানি কমেছে ১০ শতাংশ। একইভাবে ভারতের রপ্তানিও কমেছে। অর্থাৎ উৎপাদিত পণ্যের বড় অংশ দেশের বাজারেই বিক্রি হচ্ছে।
পণ্য রপ্তানি কমায় সেবা রপ্তানির মাধ্যমে এশিয়া বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে আরও বেশি করে সংযুক্ত হচ্ছে। বৈশ্বিক পরিসরে পণ্য বাণিজ্যের চেয়ে সেবা বাণিজ্য বাড়ছে ৬০ শতাংশ বেশি হারে। সেখানে এশিয়ার সেবা বাণিজ্য বাড়ছে এর চেয়ে ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি হারে। এ ক্ষেত্রে ভারত ও ফিলিপাইন সবচেয়ে এগিয়ে আছে।
করপোরেটদের উত্থান
২০১৮ সালের ফরচুন গ্লোবাল ৫০০ র্যাঙ্কিংয়ে রাজস্বের সাপেক্ষে বিশ্বের শীর্ষ ৫০০টি কোম্পানির মধ্যে ২১০টি এশীয় কোম্পানি। ম্যাককিনসে আরেকটু বড় পরিসরে দেখিয়েছে, বিশ্বের ৫ হাজার বড় ফার্মের মধ্যে এশীয় ফার্ম ছিল ৩৬ শতাংশ, ২০১৭ সালে তা উঠেছে ৪৩ শতাংশে। এই তালিকায় চীনা ফার্মের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। তবে ভারতীয় কোম্পানির সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পাশাপাশি, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, কাজাখস্তান ও বাংলাদেশের কোম্পানিও এই তালিকায় উঠে এসেছে।
শুধু শিল্প উৎপাদন বা গাড়িশিল্পেই নয়, প্রযুক্তি, আর্থিক খাত ও সরবরাহ খাতেও এশীয় করপোরেটরা বৈশ্বিক বাজারের নেতৃত্বে চলে আসছে। মূলধনি পণ্য এখন আর এই অঞ্চলের মূল পণ্য নয়, সেই জায়গায় অবকাঠামো ও আর্থিক সেবার পরিসর অনেক বেড়েছে।
ডিজিটাল উদ্ভাবন
এশিয়া এখন অনলাইন হয়ে গেছে। বিশ্বের অর্ধেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর বসবাস এখন এশিয়ায়। শুধু ভারত আর চীনেই আছে এক-তৃতীয়াংশ ব্যবহারকারীর বসবাস। এশিয়ার মধ্যে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর ডিজিটালি সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। অন্যদিকে ই-কমার্স ব্যবসার ৪০ শতাংশের বেশি হচ্ছে চীনে। বাইদু, আলিবাবা ও টেনসেন্ট মিলে চীনে এক সমৃদ্ধ ডিজিটাল ইকোসিস্টেম গড়ে তুলছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি নির্মাণেও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে।
পাশাপাশি ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণে ইন্দোনেশিয়া ও ভারত বিশ্বের গড় গতিকে ছাড়িয়ে গেছে। ডিজিটালাইজেশনে ভারত উল্লেখযোগ্য সফলতা পেয়েছে। তারা ১২০ কোটি মানুষের তথ্যভান্ডার করেছে। এতে এই মানুষেরা ব্যাংকিং, সরকারিসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা পাবে। বিপুলসংখ্যক ব্যবহারকারী ও উদ্ভাবন এশিয়াকে এই খাতের শীর্ষে নিয়ে যাবে বলে ম্যাককিনসে মনে করছে।
ভোক্তা
ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার কারণে এশিয়ায় বড় এক ভোক্তাশ্রেণি তৈরি হয়েছে। ম্যাককিনসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক ভোগ প্রবৃদ্ধির অর্ধেকের বেশি হবে এশিয়ায়। শিগগিরই এশিয়ার মধ্যবিত্তের সংখ্যা ৩০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এক দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভোক্তাশ্রেণির আকার ২০৩০ সালের মধ্যে দাঁড়াবে ১৬ কোটি ৩০ লাখে।
ভবিষ্যৎ যেখানে এশিয়ার হাতে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, চীন ও ভারত অভ্যন্তরীণ ভোগের দিকে ঝুঁকলেও বাংলাদেশের বাজার তাদের মতো এত বড় নয় বলে আরও কয়েক বছর রপ্তানি বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া দরকার। সে জন্য বিদেশি বিনিয়োগ লাগবে। আর তা আকৃষ্ট করতে অবকাঠামো ও সহজে ব্যবসার সূচকে উন্নতি করতে হবে। পাশাপাশি, চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ তৈরিতে বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
মার্কিন-ভারতীয় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ পরাগ খান্না দ্য ফিউচার ইজ এশিয়ান গ্রন্থে বলেছেন, যে ‘এশীয় শতক’ নিয়ে এত দিন এত কথা বলা হয়েছে, সেই শতক ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ২১ শতকের এই এশীয়করণকে তিনি বৈশ্বিক সভ্যতার নতুন স্তর হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।