বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলে তোলপাড়

রাজধানীসহ সারা দেশে তোলপাড় চলছে বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিল নিয়ে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে গ্রাহকরা বকেয়া মাশুল ছাড়া তিন মাসের বিদ্যুৎ বিল একসঙ্গে দেয়ার সুবিধা পেলেও ভুতুড়ে বিল নিয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। অতিরিক্ত বিল কিভাবে সমন্বয় হবে এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোনো সদুত্তর পাচ্ছেন না।

এ অবস্থায় করোনা ঝুঁকির মধ্যেই তাদের বিদ্যুৎ বিভাগের বিভিন্ন অফিসে ধরনা দিতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো অবশ্য বলেছে, অতিরিক্ত টাকা সমন্বয় করে বিল পাঠানো হয়েছে। ২-১ দিনের মধ্যে গ্রাহকরা মে মাসের যে বিল পাবেন তাতে অতিরিক্ত টাকা সমন্বয় করা থাকবে।

এদিকে মিটারে ভুতুড়ে বিলের পাশাপাশি প্রিপেইড মিটারে অতিরিক্ত টাকা কেটে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। প্রিপেইড গ্রাহকদের অভিযোগ, মিটারে টাকা লোড করার পর দু-তিন দিনের মধ্যে ব্যালেন্স জিরো হয়ে যাচ্ছে। একজন গ্রাহক গত বৃহস্পতিবার দুই হাজার টাকা লোড করলেও মাত্র ৪ দিনে তার মিটার জিরো হয়ে গেছে।

রাজধানীসহ আশপাশের গ্রাহকদের অভিযোগ গত এপ্রিল ও মে মাসের বিল আগের মাসগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। আর গ্রামে প্রতি মাসে যে বিল করা হতো তার সঙ্গে অতিরিক্ত ২০০ টাকা যোগ করে দেয়া হয়েছে। ভোগান্তি নিরসনে ক্যাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে চিঠি দিয়েছে।

ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যুৎকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সেবা দেয়ার জন্য কাজ করছে। করোনা ঝুঁকির কারণে মার্চ-এপ্রিল এই দুই মাসের বিল করা হয়েছে মিটার না দেখে। কারণ বিদ্যুৎকর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার দেখতে পারেননি।

আগের ২-৩ মাসের বিল দেখে আনুমানিক বিল পাঠানো হয়েছে। এ কারণে কোনো কোনো গ্রাহকের অতিরিক্ত বিল হয়েছে। আবার কোনো কোনো গ্রাহকের বিল কম দেয়া হয়েছে। তবে মে মাসের যে বিল তৈরি হচ্ছে সেটি মিটার দেখে প্রস্তুত করা হয়েছে। এতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়েছে সে অনুযায়ী যোগ বিয়োগের পর অতিরিক্ত বিল সমন্বয় করা হবে। তিনি বলেন, ২-১ দিনের মধ্যে গ্রাহকরা সমন্বয় করা বিল হাতে পেয়ে যাবেন। এ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করতে গ্রাহকদের অনুরোধ করেছেন।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপাকে পড়া গ্রাহকদের ভুতুড়ে বিল দ্রুত সমন্বয় করার আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি ইতোমধ্যে অতিরিক্ত বিল সমন্বয় করে গ্রাহক আঙ্গিনায় নতুন বিল পাঠানোর জন্য বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছেন। রোববার সরকারি অফিস খোলার প্রথম দিন সচিবালয়ে প্রতিমন্ত্রীর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। প্রতিমন্ত্রী জানিয়েছেন, চলতি জুন মাস পর্যন্ত বিলম্ব মাশুল ছাড়া বিদ্যুৎ বিল দেয়া যাবে।

বিল নিয়ে ভোগান্তির শিকার ধানমণ্ডির বাসিন্দা কামাল উদ্দিন জানান, মার্চ এবং এপ্রিল এই দুই মাসের বিল আগের মাসগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এই দুই মাস বাসায় মিটার রিডারও আসেননি। মিটার না দেখে অনুমাননির্ভর বিল করা হয়েছে। এখনও মে মাসের বিল তিনি পাননি। এ কারণে এই ভুতুড়ে বিল পরিশোধ করেননি। তিনি বলেন, স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসগুলো এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারছে না।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, আগে মাসে গড়ে দেড় হাজার টাকা বিল আসত। সেখানে এপ্রিল মাসের বিল করা হয়েছে তিন হাজার টাকা। মে মাসে আমার বিল ৩২শ’ টাকা দেয়া হয়েছে। দেলোয়ার হোসেন বলেন, তিনি স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে গিয়ে এই বিল দেখিয়েছেন। গত রোববার তার বাসায় মিটার রিডার এসেছিলেন। তাতে দেখা গেছে, এপ্রিল মাসে তার বিল হবে ১৬শ’ টাকা। মে মাসে ১৭শ’ টাকা। এখন এই অতিরিক্ত বিল কিভাবে সমন্বয় করা হবে সেজন্য অপেক্ষা করে আছেন।

ধানমণ্ডি মধুবাজারের বাসিন্দা ইকবাল হোসেন বলেন, জুন মাসের বিলও মাশুল ছাড়া পরিশোধের সুযোগ দেয়ায় ভালো হয়েছে। তিনি বলেন, আগে তিনি মোবাইলে বিকাশের মাধ্যমে বিল পরিশোধ করতেন। কিন্তু এপ্রিল-মে মাসে অতিরিক্ত বিল দেখে তিনি বিকাশ করেননি। এখন মে মাসের বিলের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। তিনিও জানান, সোমবার তার বাড়িতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে লোক এসে মিটার দেখে গেছেন। অতিরিক্ত বিল সমন্বয় করে নতুন করে মে মাসের বিল পাঠানো হবে বলে তাকে জানানো হয়েছে।

৪৪৪-সি, খিলগাঁওয়ের এক বাসিন্দা যুগান্তরকে বলেন, (কাস্টমার নম্বর ১১৩৪৮৩৫৮ প্রিপেইড মিটার নম্বর ০২০১২০০১২৩৬৫) গত বৃহস্পতিবার তিনি তার প্রিপেইড মিটারে দুই হাজার টাকা লোড করেছিলেন। তিনি এর আগে কোনো ইমারজেন্সি ব্যালেন্সও নেননি। কিন্তু মাত্র চার দিনের মাথায় তার মিটারে টাকা জিরো হয়ে গেছে। বিষয়টি তিনি স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসকে জানিয়েও কোনো সদুত্তর পাননি।

ডিপিডিসির এমডি বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘তিন মাসের বিলম্ব মাশুল মওকুফ করা হয়েছে। গ্রাহকদের অনেকেই তিন মাস ধরে বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছেন না। ফলে কোম্পানি বিপদের মধ্যে আছে। তিনি গ্রাহকদের দ্রুত বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে ডিপিডিসিকে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, বিল নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ নিষ্পত্তি করার জন্য তারা একটি সেল গঠন করছেন। কোনো গ্রাহক অভিযোগ জানালে মুহূর্তে ওই গ্রাহকের আঙ্গিনায় গিয়ে তা নিষ্পত্তি করা হবে।

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাওসার আমীর আলী বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিল নিয়ে কিছু কিছু অভিযোগ তারা পাচ্ছেন। ডেসকোর অনেক কর্মীও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ফলে এপ্রিল-মে মাসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার দেখা সম্ভব হয়নি। সে কারণে আগের মাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিল করা হয়েছে। ফলে এই বিল প্রকৃত ব্যবহারের চেয়ে কম বা বেশি হতে পারে, যা পরবর্তীতে মিটার দেখে সমন্বয় করব। এতে গ্রাহকদের আর্থিক কোনো ক্ষতি হবে না। যদি গ্রাহকরা ব্যবহারের চেয়ে বেশি বিল পরিশোধ করে থাকেন, তাহলে সেটি পরের মাসের বিলের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। তিনি বলেন, আমাদের কাজ হল নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার পাশাপাশি গ্রাহকদের সন্তুষ্ট রাখা।

বিদ্যুৎ বিল নিয়ে অভিযোগের বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে গ্রাহকদের একটি বার্তা পাঠানো হয়েছে বলে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ওই বার্তায় বলা হয়েছে, বর্তমান বিলের সঙ্গে গ্রাহকের প্রকৃত বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ কম বা বেশি, অথবা কোনো অসামঞ্জস্য পরিলক্ষিত হলে পরবর্তী মাসের বিলের সঙ্গে তা সমন্বয় করা হবে।

কোনো অবস্থাতেই ব্যবহৃত বিদ্যুতের বেশি বিল গ্রাহককে পরিশোধ করতে হবে না। কোনো প্রকার বিলম্ব মাশুল ছাড়াই মার্চ, এপ্রিল, মে ও জুন মাসের বিল আগামী ৩০ জুনের মধ্যে পরিশোধ করা যাবে বলেও ওই বার্তায় জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

রাজধানীর পাশাপাশি ঢাকার বাইরের গ্রাহকরাও বিল নিয়ে একই ধরনের ভোগান্তির অভিযোগ করেছেন। অভিযোগ আছে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় প্রতি মাসের বিলের সঙ্গে বাড়তি ২০০ টাকা যোগ করে দেয়া হচ্ছে।

ঢাকার বাইরে বিদ্যুতে অতিরিক্ত বিল প্রসঙ্গে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মঈন উদ্দিন বলেন, ‘করোনার কারণে মিটার রিডাররা বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিল করতে পারছেন না। তাই গত বছরের এই সময়ের বিলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এ মাসে বিদ্যুৎ বিল করা হয়েছে। অবশ্যই এই বিল সমন্বয় করব।’ ঢাকার বাইরের গ্রাহকদের অভিযোগের বিষয়ে একই কথা বলেন ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ওজোপাডিকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিক উদ্দিন এবং নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম।ভুতুড়ে বিল নিয়ে ভোগান্তি নিরসনে বিইআরসির কাছে ক্যাবের চিঠি

এদিকে বিদ্যুৎ বিলের ভোগান্তি নিরসনে বাংলাদেশ অ্যানার্জি রেগুলেটরি কমিশনের ( বিইআরসি) কাছে চিঠি দিয়েছে কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, যেকোনো পাবলিক বডির কাছে পেশ করা কোনো নাগরিকের যেকোনো আবেদনপত্র ৪৫ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হতে হবে, ক্যাবের দায়ের করা রিট মামলায় হাইকোর্টের এমন আদেশ হয়েছে। ফলে কমিশন দ্রুত তাদের আবেদনের পক্ষে পদক্ষেপ নেবে।

ক্যাবের চিঠিতে বলা হয়, করোনার কারণে মিটার রিডিং নেয়া সম্ভব না হওয়ায় গত তিন মাসের বকেয়া বিল মনগড়া হিসাবের ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে এবং একসঙ্গে তা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। ওইসব বিলে দাবিকৃত অর্থের হিসাবের কোনো যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য ভিত্তি নেই। অভিযোগের পক্ষে যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব বকেয়া বিলের পরিমাণ সম্ভাব্য যৌক্তিক পরিমাণ অপেক্ষা ১০ গুণেরও বেশি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এমন ঘটনা সরকারের ভোক্তাবান্ধব ঘোষণাকে ভোক্তাবিরোধী ঘোষণায় পরিণত করেছে। ফলে বিদ্যুৎ খাত এখন বিপর্যয়ের শিকার।

খবর সারাবেলা / ০২ জুন এপ্রিল ২০২০ / এমএম