বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে!
তুরস্কের আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন সাইয়েদ রাশেদ হাসান চৌধুরী। একাধিকবার বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে আলোচনায় এসেছেন এই তরুণ। কখনো আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক অর্জন করে, কখনো বাংলাদেশের হয়ে জার্মান সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে, কখনো-বা বাংলাদেশে চলমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা করতে বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলে অতিথি হয়ে। এছাড়াও রাশেদের গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে তুরস্ক, ব্রিটেন, জার্মানি, সাইপ্রাস, পোল্যান্ড, নেদারল্যান্ড এবং হাঙ্গেরির বিভিন্ন জার্নালে। ইউরোপের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কনফারেন্সেও নিজের গবেষণা প্রবন্ধগুলো উপস্থাপন করেছেন তিনি। এবার সর্বশেষ চমক দেখালেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের কাছ থেকে ‘মোস্ট সাকসেসফুল স্টুডেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০১৯’ (এন বাসারলি ওরেঞ্জি অদুলো) পেয়ে। এটি তুরস্কে অধ্যয়নরত প্রথম কোনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি।
আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের (২০১৮-২০১৯) শিক্ষাবর্ষের স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় সর্বোচ্চ সংখ্যক সিজিপিএ-৪.০০ এর মধ্যে ৪.০০ এবং থিওলজি ফ্যাকাল্টিতে প্রথম হয়ে রেকর্ড গড়েন তিনি। গত ৩ জুলাই, তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় তার্কিশ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ প্রাপ্তদের ৮ম কনভোকেশনের আয়োজন করা হয়। কনভোকেশনে ১৭৭ দেশের প্রায় ২ হাজার বিদেশি ছাত্রছাত্রী অংশগ্রহণ করে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ছাড়াও এই অনুষ্ঠানে অংশ নেন দেশটির বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও দপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা। সাইয়েদ রাশেদ হাছান চৌধুরী এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স এবং মাস্টার্সে অনবদ্য ফলের জন্য ডিন’স মেরিট লিস্ট অব অনার (২০১৫) ও ডিন’স মেরিট লিস্ট অব অ্যাক্সিলেন্স (২০১৮) অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। পাশাপাশ মাস্টার্সে অনবদ্য ফলের জন্য গত বছরের অক্টোবরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণ করেন। রাশেদ ২০১৬ সালে তুরস্কের সরকারি স্কলারশিপ নিয়ে আঙ্কারা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। তিনি সেখানে স্নাতোকোত্তর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বে টানা দুবার সর্বোচ্চ সংখ্যক সিজিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ৪.০০ পেয়ে বিদেশি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকর্ড তৈরি করেন।
সাইয়েদ রাশেদ হাছান চৌধুরীর বাবা সাইয়েদ মো. আলী হোছাইন চৌধুরী, মা সাইয়েদা হাছিনা হোছাইন। তিনি পিতা-মাতার বড় সন্তান। এমন অর্জনের অনুভূতি জানতে চাইলে রাশেদ বলেন, ‘প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে মোস্ট সাকসেসফুল স্টুডেন্ট অ্যাওয়ার্ড-২০১৯ পাওয়ার অনুভূতি চমৎকার। ১৭৭ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাম এবং পতাকা দেখে সত্যিই অসাধারণ লেগেছে। মনে হয়েছে দেশের জন্য কিছু করতে পেরেছি।’
এই অর্জনের পেছনে শক্তি হিসেবে কী কাজ করেছে? এমন প্রশ্নে রাশেদ বলেন, ‘‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে যে স্বপ্নগুলো দেখেছিলাম, তা বাস্তবে রূপদান করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ অবলম্বন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। ঢাবি’র অ্যাওয়ার্ডগুলো আমাকে বর্তমান অবস্থায় আনতে সাহায্য করেছে। আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পৃথিবীর প্রায় ১৮২ দেশের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছি। তখন প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলে গর্ববোধ করতাম। অনেক সহপাঠী বাংলাদেশকে চিনতো না, তারা আফ্রিকান দেশ বলতো। তখন তাদের মানচিত্র দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতাম। তখন মনে মনে ভাবতাম, এই দেশে সবচেয়ে ভালো রেজাল্ট করে বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন করতে হবে। তারই ধারাবাহিকতায় এই রেজাল্ট। এখন আমার ডিন যখন বলে, ‘বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে!’ তখন অসাধারণ অনুভূতি হয়।’’
এই সাফল্যের পথে চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে রাশেদ বলেন, ‘প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু না কিছু চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়। আমারও অনেক চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকিনি। সব সময় নিজের আত্মবিশ্বাস ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম। যখনই অবসর সময় বের করতে পারতাম, তখনই নানা ধরনের বই পড়ায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করতাম। দেশের গণ্ডি থেকে বের হয়ে বিদেশে যখন উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে আসি, তখনি ভাবতে শুরু করি, এই বুঝি মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য আরো বেড়ে গেল। বিদেশে এসেও সবসময় বাংলাদেশ নিয়ে প্রেজেন্টেশন দিতে খুবই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম।’
কারা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আব্বু-আম্মু অনেক উৎসাহ দিতেন। আব্বু প্রিন্সিপাল হওয়ায় সব সময় অনেক বড় স্বপ্ন দেখাতেন। আর বলতেন পৃথিবীকে পরিবর্তন করতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। আব্বুর অনুপ্রেরণা আমাকে এ পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছে।’
পড়ালেখায় সাফল্য অর্জন করতে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করে সামনে এগুতে হবে। আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করার পরেও আমরা লক্ষ্য ঠিক করতে পারি না। ফলে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরেও অনেকে হতাশ হন। এছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা হলো, আমরা মুখস্থনির্ভর পড়াশুনা করি। যতটুকু সম্ভব, মুখস্থ বিদ্যাকে পরিহার করে সৃজনশীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।’
‘ইচ্ছে আছে শিক্ষাবিদ হওয়ার। ইচ্ছেটা পূরণ হলে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়নে বৃহৎ পদক্ষেপ নেয়ার ইচ্ছে অবশ্যই আছে। আমাদের দেশের অনেক লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। তারা ছেলেমেয়েদের ঠিকমতো খাবার ও অন্যান্য মৌলিক অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ব্যর্থ হয়। আমি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে এসেছি। আমি দেখেছি, একটি দরিদ্র পরিবার তাদের ছেলে বা মেয়ের জন্য কত কষ্ট করে পড়াশুনার ব্যয়ভার বহন করে। আমি যেহেতু একটি রিসার্চ সেন্টারের সঙ্গে জড়িত আছি তাই আমার পরিকল্পনা হচ্ছে, এই সেন্টারের অধীনে চরাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করার জন্য প্রতিটি জেলায় শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা। এই শিক্ষাকেন্দ্রের মাধ্যমে মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি দেয়ার মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষা নিতে বিদেশে যেতে সাহায্য করা। বাংলাদেশে বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭২.৯ শতাংশ। এটিকে ১০০ শতাংশে উন্নীত করতে কাজ করে যাওয়া। পাশাপাশি আমার অন্যতম আরেকটি পরিকল্পনা হলো, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কাজ করা। শিক্ষাব্যবস্থায় যে ত্রুটিগুলো রয়েছে, পৃথিবীর বিখ্যাত শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে উন্নত দেশগুলোর সমপর্যায়ে নিয়ে আসা।’ বলছিলেন সাইয়েদ রাশেদ হাসান চৌধুরী।
অনেকেই এখন পড়ালেখায় সফল হবার জন্য আপনাকে মডেল হিসেবে ভাবছেন। আপনাকে যারা অনুসরণ করতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কি বলবেন? এ প্রসঙ্গে রাশেদ বলেন, ‘জীবনে ব্যর্থতা আসবে, বসে থাকা যাবে না। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে। আর আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে সামনে এগুতে হবে। মাধ্যমিক স্কুল থেকে জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে ফেলতে হবে। একাডেমিক পড়াশুনার পাশাপাশি অ্যানালিটিক্যাল অ্যাবিলিটি, ক্রিটিক্যাল রেজনিং, গাণিতিক বুদ্ধিমত্তা, প্রবলেম সলভিং স্কিল বাড়াতে হবে। প্রচুর বই পড়তে হবে। উন্নত দেশগুলো এই বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
খবর সারাবেলা/ ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৯/ টি আই