বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ, ফুঁসছে নদী

August 24, 2020

ভারতের মধ্যপ্রদেশের পশ্চিম ভাগ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সুস্পষ্ট লঘুচাপ অবস্থান করছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে মৌসুমী বায়ু সক্রিয় রয়েছে। বৃষ্টিপাতও হচ্ছে। এর মধ্যে আগামী তিন দিনে উত্তর বঙ্গোপসাগরেও একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। সোমবার সকালে এ তথ্য জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর।

লঘুচাপের প্রভাবে ঢাকা, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিকাংশ জায়গায় এবং রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে দেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে।

মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রবল স্রোতের কারণে কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌরুটে নৌযান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। উত্তাল পদ্মায় ১৭টি ফেরির মধ্যে ৮টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করছে ফেরি কর্তৃপক্ষ। ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় ঘাটে পণ্যবাহী ট্রাকের চাপও রয়েছে। সোমবার সকাল থেকেই ঝড়োবাতাস ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। পদ্মায় স্রোত থাকায় লঞ্চ ও স্পিডবোট চলাচলও ব্যাহত হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে সকালে এক ঘণ্টা বন্ধ ছিল স্পিডবোট।

ঘাট কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, পদ্মা নদীতে ৪ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে তীব্র স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে টানা ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার সম্ভব হচ্ছে না। ৮টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে এ নৌরুটে। ফেরি চলাচল ব্যাহত হওয়ায় যানবাহন পারাপারে কিছুটা সমস্যা হলেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ধীরে ধীরে সব যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে। তবে এ রুটে স্বল্প আকারে ফেরি চলাচল করায় ঘাটে কিছুটা দুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানা গেছে। স্বাভাবিক সময় এ নৌরুটে ১৭টি ফেরি, ৮৭টি লঞ্চ ও ২ শতাধিক স্পিডবোট চলাচল করে।

বিআইডব্লিউটিএ কাঁঠালবাড়ী ঘাট ব্যবস্থাপক আলিম মিয়া জানান, পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে তীব্র স্রোতের কারণে ফেরি চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌরুটে ৮টি ফেরি দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঘাটে থাকা যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে।

বাগেরহাট প্রতিনিধি জানান, ভারী বর্ষণে তলিয়ে গেছে সুন্দরবনের অন্যতম উঁচু পর্যটন স্থান চাঁদপাই রেঞ্জের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকা। ফলে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে থাকা বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। হরিণ, কুমির ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বাটারগুল বাচকা কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্রের প্রাণী ক্ষতির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে পানি এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে; যা থেকে রক্ষা পায়নি কুমিরের ডিম তা দেয়ার জন্য উঁচু মাটির একাধিক কেল্লা।

কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার আগেই জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে করমজল প্রজনন কেন্দ্রের ট্যাংকগুলো। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে কুমিরের ডিম পাড়া মাটির কেল্লাগুলো ডুবে যাওয়ায় এবার বাচ্চা বৃদ্ধির বিষয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

পাশাপাশি জোয়ারের পানিতে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা, কচুয়া, রামপাল ও চিতলমারীর বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দড়াটানা ও ভৈরব নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাগেরহাট জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্র রাহাতের মোড়, কাপড়পট্টি, পুরাতন বাজারসহ বেশ কিছু এলাকার মূল সড়ক পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের করমজল প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকতা আজাদ কবির জানান, সুন্দরবনের তুলনামূলক উঁচু স্থান হিসেবে পরিচিত করমজল পর্যটন কেন্দ্র তিন ফুট পানিতে তলিয়ে গেছে। লবণ ও বালুযুক্ত কাদামাটির পানিতে কুমির প্রজনন কেন্দ্রের ট্যাংকগুলো ডুবে গেছে।

তবে বেষ্টনী থাকায় এখানকার কুমির ও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির বাটারগুল বাচকা কচ্ছপগুলো রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। তবে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় বিচরণরত কুমিরগুলোর আবাসস্থল ও ডিম পাড়ার স্থান ডুবে গেছে। ফলে এবার কুমিরের বাচ্চা বৃদ্ধি অনিশ্চিত।তিনি আরো বলেন, করমজল প্রজনন কেন্দ্রের সব প্রাণী ও কুমিরের জন্য দেয়ালের পাশে থাকা উঁচু মাটির কেল্লার ডিম পানি থেকে এখনো সুরক্ষিত রয়েছে। সেখানে পানি উঠেনি।

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, সাগরের লঘুচাপের সৃষ্টির ফলে লক্ষ্মীপুরের মেঘনার অতি জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে উপকূলীয় এলাকার ৪০টি গ্রাম। সদরের মজুচৌধুরী হাট, চররমনী মোহন, কমলনগরের মাতব্বরহাট, মতিরহাট, লধুয়া, নাসিরগঞ্জ, সাহেবের হাট, রামগতির চর গজারিয়াসহ বেশ কয়েকটি এলাকা। ওইসব এলাকার লোকালয়ে পানি ঢুকে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ।

ডুবে গেছে বসতবাড়ি, মাছের ঘের, রাস্তা-ঘাট। নষ্ট হয়েছে রোপা আমন, ফসলি জমিসহ রবি শস্য। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিনটি উপজেলার কাঁচা-পাকা প্রায় ৭০ কিলোমিটার সড়ক। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কমলনগরের মতিরহাট-তোরাবগঞ্জ সড়ক, লধুয়া-হাজিরহাট সড়ক ও লরেঞ্চ-নবীগঞ্জ সড়ক। ফলে ব্যবসায়ীক যোগাযোগের পাশাপাশি যাতায়াতসহ আঞ্চলিক সড়কের সাথে যোগাযোগ বন্ধ। এতে সবচেয়ে দুর্ভোগের শিকার ওইসব এলাকার দুপাড়ের ব্যবসায়ীরা।

জানা গেছে, মেঘনা নদী তীর রক্ষা বাঁধ না থাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৭ ফুট পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব এলাকায় পানি প্রবেশ করে। বসতবাড়িতে পানি ঢুকায় বিপাকে ওইসব এলাকার বাসিন্দারা। ঘর ছেড়ে অনেকে রাস্তার পাশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। একই সাথে বিষাক্ত সাপের উপদ্রব থাকায় চিন্তিত তারা। গত শনিবার কমলনগরের তরকারির পাতিলে আশ্রয় নেয়া বিষাক্ত সাপের ছোবলে মারা যায় এক গৃহবধূ।

মেঘনা তীর রক্ষা বাঁধসহ বেশ কয়েকটি এলাকা ধসে পড়েছে। কমলনগর উপজেলা লধুয়া ঘাট এলাকায় একদিনে প্রায় এক কিলোমিটার বাঁধসহ উপকূলীয় এলাকার অনেক স্থাপনা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ১০ মিনিটে অন্তত ৫০ হাত ভেঙ্গে নদীর ভিতরে ঢুকে পড়ে। এতে আতংক ও হতাশ হয়ে পড়েছে স্থানীয়রা।

এদিকে জোয়ারের পানিতে রায়পুর উপজেলায় কয়েকটি মাছের ঘেরের অর্ধকোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে জেলা সদরের করাতিরহাট, চররমনি মোহন, ভূঁইয়ার হাট, চরমেঘা। রায়পুরের চর আবাবিল, খাসেরহাট, চরলক্ষ্মী, চরবংশী, চরভৈরবী, হাজীমারা, চর কাচিয়া, জালিয়ার চর, কুচিয়ামোড়া, চর ঘাশিয়া, টুনুর চর। কমলনগরের চরফলকন, চরমার্টিন, চরকালকিনি, চরলরেন্স, নবীগঞ্জ এবং রামগতির আলেকজান্ডারসহ প্রায় ৪০টি গ্রাম প্লাাবিত হয়।

খবর সারাবেলা / ২৪ আগস্ট ২০২০ / এমএম