ধর্ষণের সাজা বাড়িয়ে ফাঁসি

October 9, 2020

‘ধর্ষকদের আস্তানা জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’, ‘আমার মাটি, আমার মা, ধর্ষক তোদের ঠাঁই হবে না’, ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় ধর্ষকদের ঠাঁই নাই’-এমন সব স্লোগানে উত্তাল সারা দেশ। নোয়াখালীতে গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন, সিলেটের এমসি কলেজে তুলে নিয়ে ধর্ষণসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সা¤প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ এবং দোষীদের শাস্তির দাবিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে একই স্লোগানে প্রতিবাদমুখর দেশের ছাত্রসমাজও। এমন প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ করার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশের আইনে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশের পর শাস্তি বাড়িয়ে ধর্ষণের আইনটি সংশোধন করার প্রক্রিয়া এরই মধ্যে শুরু করে দিয়েছে আইন মন্ত্রণালয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দেয়ার পরই আইনটির সংশোধনী মন্ত্রিসভায় তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগামী সোমবারই মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটির সংশোধনী প্রস্তাব উপস্থাপন করা হবে। অবশ্য গত বুধবারই আইনমন্ত্রী জানিয়েছিলেন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি সরকার বিবেচনা করছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পাওয়ার পর সেটিই চ‚ড়ান্তভাবে ঘোষণা করলেন তিনি।

সিলেটে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে তরুণী নববধূকে দল বেঁধে ধর্ষণের পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর পর থেকে গত কয়েক দিন ধরে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবি উঠেছে প্রতিবাদ সমাবেশগুলো থেকে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ থেকে এ দাবি উঠলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বরাবরই মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে নয়। বরং তারা বলছে, আইনে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবনের যে সাজা এখন আছে, সেটির প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাচ্ছে না বলেই এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে।

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর ধর্ষণের শিকার নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড। এর পাশাপাশি দুই ক্ষেত্রেই অর্থদণ্ডের বিধান আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের আগে ধর্ষণের ঘটনায় জরিমানার বিষয়টি বাধ্যতামূলক ছিল না। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে জরিমানা বাধ্যতামূলক করা হয়।

এই আইনে বলা হয়, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ-পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন। ইহা ছাড়া যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন; তাহা হইলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন। আর যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটাইবার চেষ্টা করে বা আহত করিবার চেষ্টা করে তাহা হইলে তাহার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হইবে। আর ধর্ষণের চেষ্টা করিলে ১০ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হইবে।’

তবে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবির হুদা বলেন, বর্তমানে ধর্ষণ বিষয়ক আইনটিতে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু উল্লেখ করা নেই। তার মতে, এই আইনে অর্থদণ্ডের কথা উল্লেখ করা হলেও সেটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে দেয়া হবে কি না সে বিষয়টি উল্লেখ নেই। সে বিষয়টি পুরোপুরি বিচারক তথা আদালতের ওপর নির্ভর করে।

এ আইনের মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়ার জন্য সাত দিন থেকে এক মাস এবং মামলা নিষ্পত্তির জন্য ১৮০ দিন সময় বেঁধে দেয়া থাকলেও বাস্তবে ওই সময়ের মধ্যে রায় দেয়া সম্ভব হয় না। তা ছাড়া ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের একেকটি ঘটনা কিছুদিন পর পর সারা দেশকে নাড়া দিয়ে গেলেও এসব ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তির নজির কম। ধর্ষণের বেশির ভাগ মামলা বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় ধামাচাপা পড়ে যায়। তা ছাড়া ঠিকমতো ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়া, সামাজিক জড়তা, প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপসহ নানা কারণে বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।

আইন ও সালিশ কেন্দে র তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে দেশে ৮৮৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ধর্ষণের পর মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। আর এই আট মাসে ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৯২ জন নারী এবং ৯ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। তবে অনেক অভিযোগ থানা পর্যন্ত না পৌঁছানোয় প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে অধিকারকর্মীদের ধারণা।

এদিকে সরকারি তথ্যানুযায়ী, ধর্ষণের শিকার নারীদের সারা দেশে আটটি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে কাউন্সেলিং, পুলিশি ও আইনি সহায়তা দেয়া হয়। ২০০১ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিষ্ঠিত এসব কেন্দ্র থেকে চার হাজার ৩৪১টি যৌন নির্যাতনের মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৫৭৮টির বিচার হয়েছে এবং সাজা হয়েছে মাত্র ৬৪টি ঘটনার।

ঢাকা মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের কো-অর্ডিনেটর ডাক্তার বিলকিস বেগম এ বিষয়ে বলেন, ‘শারীরিক পরীক্ষা যথাসময়ে না হলে ধর্ষণের প্রমাণ এবং পরবর্তী সময়ে বিচার পাওয়া কঠিন। প্রমাণ করা না গেলে বিচার পাওয়া যাবে নাÑএটাই তো স্বাভাবিক।’

মূলত এসব কারণে ধর্ষণের অপরাধে শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান করার পাশাপাশি দ্রæততম সময়ে বিচার ও রায় কার্যকর করার জন্য আইন সংশোধনের দাবি তোলে বিভিন্ন সংগঠন। দেশব্যাপী এসব সংগঠনের ব্যানারে প্রতিবাদের পাশাপাশি রাজধানীর শাহবাগে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দাবি করে। সা¤প্রতিক সময়ে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের একের পর এক ঘটনায় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে উকিল নোটিশ পাঠিয়েছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আইন সম্পাদক মোহাম্মদ ফুয়াদ হোসেন। সেখানে ধর্ষণের দ্রুত বিচারে বিশেষ আদালত গঠন এবং ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন তিনি।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে সমর্থন জানিয়েছেন। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘ধর্ষকদের লঘুদণ্ড দিয়ে লাভ নেই। সর্বোচ্চ বিচারের যে দাবি উঠেছে, আমার মনে হয় এটা অযৌক্তিক নয়। এসব অপরাধীর বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনকে আপসহীন মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’

জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীও গতকাল এক অনুষ্ঠানে ধর্ষকদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন। জাতীয় সংসদের শপথ কক্ষে ইউএনএফপিএর কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয় বাস্তবায়নাধীন ‘এসপিসিপিডি’ প্রকল্পের আওতায় “কনসার্টেড রেসপন্স টু স্টপ চাইল্ড ম্যারেজ, প্রিভেন্ট জেন্ডার বেসড ভায়োলেন্স অ্যান্ড ইমপ্রোভ মেটার্নাল হেলথ ডিউরিং ন্যাচারাল ডিজাস্টার অ্যান্ড কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক’ শীর্ষক পলিসি ডায়ালগে এই তাগিদ দেন স্পিকার।

এদিকে চলতি বছর জানুয়ারিতে শিশু ধর্ষণের ঘটনায় এক রিট মামলায় রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্টের । ১৬ বছর বা তার কম বয়সী শিশু ধর্ষণের শিকার হলে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রেখে আইন করতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চাওয়া হয়েছিল সেই রুলে। বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।

খবর সারাবেলা / ০৯ অক্টোবর ২০২০ / এমএম