টিকা নিয়ে ভারতের নিষেধাজ্ঞা নেই

ভারতে থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার করোনা টিকা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ীই পাবে বাংলাদেশ। টিকা রফতানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুদিন ধরে চলা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অচিরেই দূর হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে- টিকা পেতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভারত সরকার জানিয়েছে, টিকা সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এর রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। গত রবিবার ভারতে করোনার টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালার এক বক্তব্যে বাংলাদেশে টিকা প্রাপ্তি নিয়ে এ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার বিকালে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, করোনার টিকা রফতানিতে ভারত কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। ভারতের স্বাস্থ্যসচিব রাজেশ ভ‚ষণ বলেন, টিকা সংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষই এর রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়নি।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা এদিন ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানান, টিকা সরবরাহ বাণ্যিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় হবে না। তবে বৃহৎ পরিসরে উৎপাদন শুরু হলে বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশকে এই টিকা সরবরাহ করা হবে। সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহীর দেয়া বক্তব্যে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কারণ ভারত সবসময় তার প্রতিবেশীদের প্রাধান্য দেয়।

এদিকে একদিনের ব্যবধানে নিজের বক্তব্য থেকে সরে এসেছেন সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালা। একটি আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তার বক্তব্য নিয়ে দুদিন ধরে বিভ্রান্তি চলার পর মঙ্গলবার টুইট করে তিনি জানান, ভারত থেকে সব দেশেই টিকা রফতানির অনুমোদন আছে। টুইটে আদর পুনাওয়ালা লিখেছেন, যেহেতু সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, তাই তিনি বিষয়টি স্পষ্ট করতে চান।

ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের সূত্রের বরাত দিয়ে ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘টিকা রফতানি নিষেধাজ্ঞা নিয়ে গণমাধ্যমের খবরে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়টি পরিষ্কার করেছে ভারত। ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলাদেশকে টিকা সরবরাহে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারত গোটা মানবজাতির জন্যই টিকা তৈরি করছে এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশকেও টিকা সরবরাহে আমাদের নেতৃবৃন্দ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

এদিকে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান বলেছেন, ‘করোনা ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের শীর্ষ পর্যায় অবগত আছেন। তাই আশা করি ভ্যাকসিন পেতে দেরি হবে না।’ মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় তিনি একথা বলেন।

তিনি আরো বলেন, ‘ভ্যাকসিন জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট) পর্যায়ে না বেসরকারিভাবে আসবে, সেটা কোনো বিষয় নয়।’ এর আগে গত সোমবার তিনি ঢাকায় ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার বিশ্বজিৎ দে-কে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছে, সেটি জিটুজি (গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট)। বাণিজ্যিকভাবে যাদের সঙ্গে সেরামের চুক্তি হয়েছে তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে।

দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তি এর আওতার বাইরে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা মিলে করোনা ভাইরাসের যে টিকা তৈরি করেছে, তার উৎপাদন ও বিপণনের সঙ্গ যুক্ত রয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া। কোভিশিল্ড নামের ওই টিকার ৩ কোটি ডোজ কিনতে গত ৫ নভেম্বর সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর গত সোমবার এই টিকা আমদানি ও জরুরি ব্যবহারের অনুমোদনও দিয়ে দিয়েছে।

বাংলাদেশে সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত টিকার ‘এক্সক্লুসিভ ডিস্ট্রিবিউটর’ বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা কোভিশিল্ড ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার এক মাসের মধ্যে ৫০ লাখ ডোজ টিকার প্রথম চালান পাঠানোর কথা সেরাম ইনস্টিটিউটের। ভারত গত রবিবার সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত টিকা ব্যবহারের চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে বাংলাদেশেও তা দ্রুত পাওয়ার আশা তৈরি হয়।

কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী আদর পুনাওয়ালার বরাত দিয়ে রবিবার রাতে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, রফতানি শুরুর আগে আগামী দুই মাস তারা ভারতের স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতেই জোর দেবে। ওই খবরে বাংলাদেশের টিকা পাওয়া বিলম্বিত হতে পারে বলে শঙ্কা তৈরি হয়। এই প্রেক্ষাপটে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান গত সোমবার দফায় দফায় সংবাদ সম্মেলন করে সবাইকে টিকা প্রাপ্তির বিষয়টি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘আমরা এ বিষয় নিয়ে এতগুলো জায়গায় আলোচনা করেছি। আমরা আশ্বস্ত যে এটা কোনো সমস্যা হবে না। সমাধান আশা করি হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমরা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের চুক্তি যেটা, আপনারাও জানেন, সেই চুক্তি অনুযায়ী, তাদের ভ্যাকসিন যখন অনুমোদন পাবে, ডব্লিউএইচওর অনুমোদনও তারা নেবে।

ডব্লিউএইচওর অনুমোদনের পরে তারা আমাদের ভ্যাকসিন দিতে পারবে। এটা আমাদের চুক্তিতেও আছে। তারা এখন তাদের সরকারের অনুমোদন পেয়েছে। এখন তারা ডব্লিউএইচওর কাছে আবেদন করবে এবং আবেদনের প্রেক্ষিতে আশা করব তারা অনুমোদনও তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবে। অনুমোদন পাওয়ার পরে তারা আবারো আমাদের জানাবে যে, আমরা কবে পাব।

আমরা আশা করি, যতটুকু আমাদের আলোচনা হয়েছে, সেই আলোচনা অনুযায়ী আমরা এখনো আশ্বস্ত থাকতে পারি যে, আমরা হয়তো আমাদের চুক্তি অনুযায়ী ভ্যাকসিন পাব।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, আমাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় যে চুক্তি হয়েছে সেটি পালন করা হবে। ওরা বলেছে ভ্যাকসিনের বিষয়ে অন্য ব্যান (নিষেধাজ্ঞা) থাকতে পারে। কিন্তু যেহেতু একদম উচ্চ পর্যায়, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে আলাপ করে এটা হয়েছে, কাজেই বাংলাদেশ প্রথম ভ্যাকসিন পাবে। কোনো ধরনের ব্যান এখানে কার্যকর হবে না। ভারত যখন করোনার ভ্যাকসিন পাবে, একই সময়ে বাংলাদেশকেও ভ্যাকসিন সরবরাহ করবে সেরাম ইনস্টিটিউট।’

আর বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে জানান, চুক্তি অনুযায়ী ‘নির্ধারিত সময়েই’ বাংলাদেশ টিকা পাবে, দেরি হওয়ার কোনো ইঙ্গিত তারা সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে পাননি।

তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমি বা আমরা এটা নিয়ে অতটা চিন্তিত না। কারণ আমার এগ্রিমেন্টটা হয়ে গেছে। ওই চুক্তিতে ক্লিয়ারকাট বলা আছে, আমাদের দেশে অ্যাপ্রুভাল দেয়ার এক মাসের মধ্যে তারা আমাদের টিকা পাঠাবে।’

খবর সারাবেলা / ০৬ জানুয়ারি ২০২১/এমএম