চীনা ভ্যাকসিন ট্রায়াল হবে বাংলাদেশে
চীনা সিনোভ্যাক বায়োটেক কোম্পানির করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এর টিকা ট্রায়ালের অনুমতি দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
তিনি বলেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন দেয়ার শর্তে চীনা কোম্পানি সিনোভ্যাককে তাদের আবিষ্কৃত করোনা টিকা বাংলাদেশে ট্রায়ালের অনুমতি দেয়া হয়েছে। যে ভ্যাকসিনই আসুক, তার ট্রায়াল লাগবে। তাই নীতিগতভাবে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে থাকা চীনের নাগরিক ও দূতাবাসের লোকদের ওপরও ট্রায়াল করবে কোম্পানিটি। তাদের বলা হয়েছে ট্রায়ালের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আরো বলেন, যারা স্বেচ্ছায় ভ্যাকসিনের ট্রায়াল বাংলাদেশে করতে আগ্রহী হবে তাদেরই অনুমতি দেয়া হবে। এর আগে আইসিডিডিআরবিকে এই ট্রায়ালের অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল-বিএমআরসি। তবে চ‚ড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এতদিন তা ঝুলে ছিল।
গত ২০ আগস্ট করোনা টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে বিবৃতি দিয়েছিল বাংলাদেশের কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। কমিটি তখন বলেছিল বাংলাদেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার উদ্দেশে এই ট্রায়াল বাংলাদেশে চালানো উচিত।
রোগত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলছেন, ‘বাংলাদেশের জন্য একটি ভ্যাকসিন খুবই দরকার কারণ বাংলাদেশ অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। এত দীর্ঘদিন ধরে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে সবকিছু বন্ধ রেখে মানুষকে ঘরে রাখা খুবই সমস্যার একটি বিষয়। কারণ জীবন টিকিয়ে রাখতে হলে জীবিকাও লাগবে।’
আবিষ্কারে দৌড়ে ১৭০টির বেশি উদ্যোগ : বিশ্বের প্রায় ১৭০টির মতো কোম্পানি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিন আবিষ্কারে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে ট্রায়ালে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড, চীনের সিনোভ্যাক, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, অস্ট্রেলিয়ার মারডক চিলড্রেনস রিসার্চ ইনস্টিটিউট। ছয়টি ভ্যাকসিন ক্লিনিকাল ট্রায়ালের তৃতীয় ধাপে রয়েছে। একেকটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষা-পর্ব সারতেই সাধারণত বছরের পর বছর সময় লাগে।
সেখানে করোনার ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৮ মাসে নামিয়ে আনার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। বেশিরভাগ প্রচেষ্টাই এখনো প্রাক ক্লিনিক্যাল পর্যায়ে রয়েছে। এই ধাপে বিজ্ঞানীরা ভাইরাস বা তার কোনো একটি অংশ তৈরি করেন। সেটি অন্য প্রাণিদের ওপর প্রয়োগ করে দেখেন রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ঠিকঠাক সাড়া দিচ্ছে কিনা। ১৩৯টি প্রচেষ্টা এখনো এই ধাপে আটকে আছে। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার প্রথম ধাপে সীমিতসংখ্যক মানুষের মধ্যে টিকাটি প্রয়োগ করা হয়।
দেখা হয়, প্রাক ক্লিনিক্যাল পর্বে পশুর দেহে যেভাবে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, মানুষের শরীরেও তা একইভাবে কাজ করছে কিনা। বর্তমানে ২৫টি টিকা রয়েছে এই ধাপে। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছাতে পেরেছে ১৭টি ভ্যাকসিন। সম্ভাব্য টিকাটি কতটা নিরাপদ আর তা কী মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে- এই ধাপে মূলত সেটি দেখেন বিজ্ঞানীরা।
সেজন্য কয়েকশ’ মানুষের শরীরে টিকাটি পরীক্ষা করা হয়। তৃতীয় ধাপে ভ্যাকসিন পরীক্ষার আওতায় আসেন কয়েক হাজার মানুষ। কার্যকারিতা, শরীরে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকগুলোতে এই পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা মনযোগ দেন।
এই ধাপটিতে এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯)- এর মাত্র ছয়টি সম্ভাব্য ভ্যাকসিন পৌঁছাতে পেরেছে। পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন বাজারজাতের অনুমোদন দেয় দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বর্তমানে ১৭টি ভ্যাকসিন মানবদেহে পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং ভ্যাকসিন উন্নয়নের প্রাথমিক ধাপে রয়েছে আরো ১৩৯টি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বৈজ্ঞানিক সৌম্য স্বামীনাথান অবশ্য বলেছেন, ‘এ মুহূর্তে তাদের হাতে কোনো প্রমাণিত ভ্যাকসিন নেই। ভাগ্য ভালো হলে এ বছর শেষ হওয়ার আগেই এক বা দুটি কার্যকর ভ্যাকসিন হাতে চলে আসবে’।
আলোচনায় অক্সফোর্ড : শুরু থেকে আলোচনায় রয়েছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ব্রিটিশ-সুইডিশ কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে তারা। পৌঁছে গেছে তাদের উদ্ভাবিত টিকা পরীক্ষার শেষ ধাপে। দক্ষিণ আফ্রিকা আর ব্রাজিলে চলছে তার ট্রায়াল।
তৃতীয় ধাপে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্না: যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এবং যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার তৈরি দুটি ভ্যাকিসন এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ আলোচনায় রয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী হিসেবে পরিচিত গ্লাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) গত শুক্রবার তাদের ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা পর্যায়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ভ্যাকসিন পরীক্ষার তৃতীয় ধাপে রয়েছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মডার্না।
গ্লাক্সোস্মিথক্লাইনের ভ্যাকসিন প্রকল্পের প্রধান মেডিকেল কর্মকর্তা থমাস ব্রুয়েরার বলেছেন, প্রতিষ্ঠিত প্রযুক্তি ধরে এগোলেই তারা সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে পারবেন। তারা এখন অ্যাডজুভান্ট তৈরি করছেন, যা মূলত বুস্টার হিসেবে প্রচলিত ভ্যাকসিনের সঙ্গে কাজ করে। অ্যাডজুভান্ট বয়স্কদের ক্ষেত্রে প্রতিরোধী ক্ষমতা বাড়াতে বেশি কার্যকর হবে। আগামী বছর ১০০ কোটি ডোজ বুস্টার তৈরি করবেন তারা।
চীনা জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ক্লোভার বায়োফার্মাসিউটিক্যালস, শিয়ামেন ইনোভ্যাক্স অ্যান্ড চংকুয়িন জেইফি ও অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও সানোফিকে এ অ্যাডজুভান্ট সরবরাহ করবে। তারা জানায়, তাদের করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) এস-ট্রিমার সাব-ইউনিট ভ্যাকসিন প্রথম ধাপে মানবপরীক্ষায় শুরু হয়েছে। তারা চীনের ষষ্ঠ ভ্যাকসিন নির্মাতা হিসেবে মানবপরীক্ষার ধাপে পৌঁছেছে।
১৫০ জন প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর মধ্যে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হচ্ছে, যাতে জিএসকের বুস্টারের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের ডায়নাভ্যাক্সের বুস্টারের সঙ্গে তাদের ভ্যাকসিন পরীক্ষা করা হবে। অস্ট্রেলিয়ার পার্থে লিনেয়ার ক্লিনিক্যাল রিসার্চে এ গবেষণা চালানো হচ্ছে। বছরের শেষ নাগাদ এ নিয়ে পরের ধাপের পরীক্ষা চালানো হবে। এটি মূলত প্রোটিনভিত্তিক অ্যান্টিজেন পরীক্ষা, যা অ্যাডজুভান্টের সঙ্গে শরীরে প্রয়োগ করা হয়।
মানবপরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে চীন : ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজির একটি করোনা ভাইরাস ( কোভিড-১৯) ভ্যাকসিন চীনে মানবপরীক্ষার দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করেছে। চায়নিজ একাডেমি অব মেডিকেল সায়েন্সের অধীনে থাকা ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজির গবেষকেরা এর আগে পোলিও এবং হেপাটাইটিস এ-র জন্য ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন। তারা কোভিড-১৯-এর জন্য একটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রথম পর্বের পরীক্ষা চালিয়ে সফল হওয়ার দাবি করেছেন।
ভ্যাকসিনটির দ্বিতীয় ধাপের পরীক্ষায় মানবদেহে এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিরূপণ ও নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যালোচনা করা হবে। এটি চীনের দক্ষিণ-পূর্ব ইউনান প্রদেশে পরীক্ষা করা হচ্ছে। গত মে মাসে ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজির গবেষকেরা ভ্যাকসিনের প্রথম ধাপের পরীক্ষা শুরু করেন।
সিচুয়ান প্রদেশের ওয়েস্ট চায়না সেকেন্ড ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ১৮ থেকে ৫৯ বছর বয়সী ২০০ স্বেচ্ছাসেবী ভ্যাকসিন গ্রহণ করেছিলেন। এই ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে ভ্যাকসিন উৎপাদন কারখানা স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে। চলতি বছরের শেষ দিকে এ কারখানা থেকে ভ্যাকসিন উৎপাদন শুরু করবে তারা।
কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির দাবি ইতালির : ইতালির গবেষকদের দাবি, বিশ্বে করোনা ভাইরাসের প্রথম ভ্যাকসিন তারা তৈরি করে ফেলেছেন। তাদের দাবি অনুযায়ী, এমন ভ্যাকসিন তারা আবিষ্কার করেছেন, যা মানুষের কোষে ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম হয়েছে। তারা অ্যান্টিবডি সমৃদ্ধ রক্ত থেকে সিরামকে আলাদা করে এ ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন। গ্রীষ্মে মানবদেহে এ ভ্যাকসিনের পরীক্ষা শুরু হবে বলে আশা করছেন তারা।
ইসরাইলে ইঁদুরের ওপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ: ইসরাইলে ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসার্চ সেন্টার দাবি করেছে, তারা ইঁদুরের ওপর করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) ভ্যাকসিনের সফল পরীক্ষা করেছে। টাইমস অব ইসরাইল জানায়, চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা তার আগেই ভ্যাকসিন চ‚ড়ান্ত হয়ে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের দাবি, মিসেলস, মাম্পস ও রুবেলা (এমএমআর) ভ্যাকসিন কোভিড-১৯- এর ক্ষেত্রে বাড়তি সুরক্ষা দিতে পারে। এ নিয়ে আরো ক্লিনিক্যাল পরীক্ষার দাবি করছেন তারা। ‘এমবায়ো’ সাময়িকীতে প্রকাশিত গবেষণা নিবন্ধে গবেষকরা দাবি করেছেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণে প্রদাহ কমাতে পারে এমএমআর ভ্যাকসিন।
রাশিয়ার কার্যক্রম : প্রথম দেশ হিসেবে করোনার ভ্যাকসিনের নিবন্ধন করেছে রাশিয়া। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের আগেই নিবন্ধন করানোয় রাশিয়া এবং বাইরের বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী ভ্যাকসিনটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমি পুটিন অবশ্য দাবি করেছেন, পর্যাপ্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। তবে এখনই ব্যাপক পরিসরে ভ্যাকসিন উৎপাদন করবে না রাশিয়া। তা শুরু হবে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে।
অন্যান্য দেশের তৎপরতা : ভ্যাকসিন তৈরির পথে জাপান। জাপানের নিক্কেই এশিয়ান রিভিউ জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের একটি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ও বিশ্বের আরো কয়েকটি কোম্পানি কয়েক শ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এ ভ্যাকসিন জাপান আমদানি করতে পারবে কি- না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই দেশটির সরকার করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় তরঙ্গ সামাল দিতে ভ্যাকসিনের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। জাপানের ভ্যাকসিনটি এখনো উন্নয়ন পর্যায়ে।
ভারতেও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু : বুধবার ভারতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়েছে। অক্সফোর্ডের এ সম্ভাব্য টিকাটি পুনের সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া (এসআইআই) থেকে উৎপাদিত হচ্ছে। ভারতীয় বিদ্যাপীঠ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে দুই পুরুষ স্বেচ্ছাসেবীর শরীরে এই টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে।
খবর সারাবেলা / ২৮ আগস্ট ২০২০ / এমএম