গতির বাহন থামিয়ে দিচ্ছে জীবনের গতি
চলতি বছর ১৬ মে, মঙ্গলবার। এদিন সন্ধ্যায় ফরিদপুরে হোসেন, জুবায়ের ও নাহিদ নামের তিন যুবক একটি মোটরসাইকেলে চড়ে ঢাকা-খুলনা মহাসড়ক ধরে বাড়ি ফিরছিলেন। পথিমধ্যে তারা কালবৈশাখীর কবলে পড়েন। ঝড়ে রাস্তার পাশের গাছ থেকে ডাল ভেঙে পড়ে মোটরসাইকেলের ওপর। এতে যানটি পিছলে পড়ে। আরোহী তিনজনই ছিটকে রাস্তার ওপর পড়ে যান এবং বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারান। এর ঠিক আগে ৮ মে গোপালগঞ্জে ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী তিন কিশোর ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হয়। একটি মোটরসাইকেলে করে একই মহাসড়ক ধরে বাড়ি ফিরছিল তারা। মাত্র ১০ দিনের কম সময়ের ব্যবধানে দুটি দুর্ঘটনায় ছয়জনের মৃত্যু আরও একবার বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের উচ্চ ঝুঁকির বিষয়টি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
দুটি ঘটনাতেই আরোহীরা তিনজন এক মোটরসাইকেলে চড়ে আইন ভঙ্গ করেছেন। কারণ, দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে বলে এতে দুজনের বেশি ওঠা নিষিদ্ধ। তারা হেলমেট পরিধান করেছিলেন কি না তা জানা যায়নি। যদি হেলমেট না পরেই ভ্রমণ করে থাকেন, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনায় পড়া মোটরসাইকেল আরোহীদের ৮৮ শতাংশেরই মাথায় হেলমেট ছিল না।
বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের এক গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ২০১৯ থেকে ২০২২- এই চার বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা আড়াই গুণ বেড়েছে। এর একটা কারণ নিশ্চয়ই মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে বর্তমানে নিবন্ধিত মোটরযানের মধ্যে ৬০ শতাংশই মোটরসাইকেল। বর্তমানে মোট চালকের ৩৪ শতাংশ সবসময় হেলমেট ব্যবহার করেন। বেশিরভাগ সময় ব্যবহার করেন ৫৩ শতাংশ চালক। ১০ শতাংশ চালক কিছু সময় ও দুই শতাংশ চালক কখনোই হেলমেট ব্যবহার করেন না।
অন্যদিকে, বাজারে যে তিন ধরনের হেলমেট পাওয়া যায়, তার মধ্যে ঢাকা শহরে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ফুল ফেস ক্লোসড হেলমেট ব্যবহার করেন মাত্র ১১ শতাংশ চালক ও মাত্র ২ শতাংশ আরোহী। এসব চালকের বেশির ভাগই, অর্থাৎ ৬৫ শতাংশই ব্যবহার করেন হাফ ফেস হেলমেট। ওপেন ফেস বা হ্যাট ধরনের খোলা হেলমেট ব্যবহার করেন ২৪ শতাংশ চালক।
এ ব্যাপারে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, বাজারে গুণগত মানের হেলমেটের নিশ্চয়তা ও সঠিকভাবে যদি হেলমেটের ব্যবহার করা হয় তাহলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহতের ঘটনা ৭০ শতাংশ কমে যাবে ও মৃত্যু কমবে ৩০ শতাংশ। কিন্তু বাজারে যে সব হেলমেট পাওয়া যায়, সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ। এগুলো পরে শুধু আইন রক্ষা হবে, দুর্ঘটনা হলে চালক বা আরোহীকে বাঁচানো যাবে না।
কম দূরত্বে হেলমেট পরেন না ৬৩% চালক: গবেষণায় দেখা গেছে, কম দূরত্বের সময় মোটরসাইকেল চালকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হেলমেট পরেন না। এই সংখ্যা ৬৩ শতাংশ। গরম আবহাওয়ার সময় হেলমেট পরেন না ২০ শতাংশ চালক। ১৫ শতাংশ চালক রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে পড়লেই কেবল হেলমেট পরেন। পাড়া-মহল্লার রাস্তা বা গলিতে মোটরসাইকেল চালানোর সময় হেলমেট পরেন না ১২ শতাংশ চালক। এ ছাড়া দিনের বেলা হেলমেট পরেন না ৩ শতাংশ এবং রাতে ও দিনে হেলমেট পরেন না দুই শতাংশ করে চালক।
অর্ধেক চালক হেলমেট পরেন না অস্বস্তির কারণে: গবেষণায় হেলমেট না পরার যে সুনির্দিষ্ট ১০টি কারণ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে অন্যতম অস্বস্তিবোধ করা। গবেষণায় বলা হয়েছে, ৪৫ শতাংশ চালকই হেলমেট পরেন না অস্বস্তির কারণে। গরম লাগে ও শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুবিধা হয়- এই দুই কারণে হেলমেট পরেন না ২১ শতাংশ করে চালক। হেলমেট পরলে দেখতে অসুবিধা হয়- এ কারণে পরেন না ১৮ শতাংশ চালক। এমনকি এলাকার রাস্তাঘাটে ধীরে মোটরসাইকেল চালান বলে হেলমেট পরেন না ২২ শতাংশ চালক। এছাড়া নাকে ব্যথা পান- সে কারণে ৯ শতাংশ, খুব ভালো চালান এমন অতি আত্মবিশ্বাসের কারণে ৫ শতাংশ ও দামের কারণে ৪ শতাংশ চালক হেলমেট পরেন না।
ঢাকায় হেলমেটের ব্যবহার বেশি: দেশের দুই জেলা শহর ঢাকা ও বরিশাল, একটি এক্সপ্রেসওয়ে মাওয়া, দুটি হাইওয়ে গাইবান্ধার পলাশবাড়ী ও বরিশাল-পটুয়াখালী এবং একটি আঞ্চলিক সড়ক বাকেরগঞ্জ-বরগুনা সড়কের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হেলমেট ব্যবহার করেন ঢাকা শহরের মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীরা। ঢাকা শহরে প্রায় শতভাগ (৯১ দশমিক ৮ শতাংশ) মোটরসাইকেল চালক হেলমেট ব্যবহার করেন। এখানে আরোহীদের মধ্যে ৯৬ শতাংশ পুরুষ ও ৮৭ শতাংশ নারী হেলমেট পরেন।
বরিশাল শহরে হেলমেটের ব্যবহার খুবই কম। এখানে চালকদের ৭৮ শতাংশ হেলমেট পরলেও চালক-আরোহী মিলে হেলমেট ব্যবহার করেন মাত্র ৫৬ শতাংশ। এখানে আরোহীদের মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ হেলমেট পরেন। নারী আরোহীদের হেলমেট পরার হার শূন্য। মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে হেলমেট পরেন ৯০ শতাংশ চালক-আরোহী। এই সড়কে নারী চালকদের শতভাগ ও আরোহীদের ৮৬ শতাংশ এবং পুরুষ চালকদের ৯৬ শতাংশ ও আরোহীদের ৭৪ শতাংশ হেলমেট পরেন।
মোটরসাইকেল চালকদের ৮৪ শতাংশই হেলমেট পরার পক্ষে তাদের মত দিয়েছেন। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১৬ শতাংশ চালক মনে করেন হেলমেট না পরলেও চলে ও ২৫ শতাংশ চালকই মনে করেন তার পেছনে থাকা আরোহীর হেলমেট না পরলেও চলে। ৮৪ শতাংশ চালক মনে করেন হেলমেট পরা থাকলে দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, ৩৪ শতাংশ চালক মনে করেন সড়কে ধীরে চালানোর সময় ও কম দূরত্বে ৭৩ শতাংশ চালক মনে করেন রাতের চেয়ে দিনে হেলমেটের দরকার বেশি। আর ৩০ শতাংশ চালক হেলমেট পরেন শুধু পুলিশি ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকতে।
বাজারে নানা হেলমেট, নেই তদারকি: পুরান ঢাকার সবচেয়ে বড় পাইকারি হেলমেটের মার্কেট বংশালে দেখা গেছে, দোকানগুলোতে সার্টিফাইড হেলমেট দাবি করে বিক্রি করার পাশাপাশি ক্রেতাদের চাহিদা মতো নিম্নমানের হেলমেটও বিক্রি হচ্ছে। সর্বনিম্ন ২শ টাকার হেলমেট যেমন রয়েছে, তেমনি দুই হাজার-আড়াই হাজার টাকার হেলমেটও বিক্রি হচ্ছে। বংশালের এশিয়া এগ্রো ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হাশেম বলেন, আমরা কখনও চাই না মানুষ কম দামি হেলমেট কিনে সড়কে মৃত্যুমুখে পড়ুক। আমরা নি¤œ মানের হেলমেটকে বলি আইন রক্ষার হেলমেট। এই হেলমেট দিয়ে দেশে আইন রক্ষা হয়, তবে জীবন রক্ষা হবে না। আমাদের কাছে অনেক ভালো হেলমেটও আছে। এই মার্কেটের কনকর্ড ইন্টারন্যাশনালের বিক্রেতা মো. হাসান বলেন, সবরকমের হেলমেট পাওয়া যায় এই মার্কেটে। কেউ ফুল ফেস, কেউ হাফ ফেস, কেউ খোলা ফেস হেলমেট, আবার কেউ নরমাল হেলমেট কেনেন। তবে কমদামি হেলমেট কিনতে চান বেশিরভাগ ক্রেতা।
তবে হেলমেটের গুণগত মান রক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে কোনো তদারকি নেই বলে জানান অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, বিএসটিআইয়ের হেলমেটের গুণগত মান যাচাইয়ের কাজ করা উচিত। তারা যদি এটা ভালোভাবে মনিটরিং করে তাহলে বাজারে নিম্নমানের হেলমেট কমে যাবে। তবে মোটরসাইকেলের যারা চালক ও আরোহী আছেন তাদের একটি কথা মনে রাখতে হবে- হেলমেট কেনার ক্ষেত্রে কম দামি হেলমেট কিনে নিজেদের ক্ষতি না করে ভালো মানের হেলমেট কেনা দরকার। এতে মোটরসাইকেলে মৃত্যুর সংখা অনেকটাই কমে যাবে বলে জানান তিনি।
খবর সারাবেলা / ১৬ জুন ২০২৩ / এমএম