করোনা সংক্রমণ কোন পথে

September 11, 2020

বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাব ও সংক্রমণের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। সপ্তম মাসে এসে সংক্রমণের গতি কিছুটা কমে আসতে শুরু করেছে। তবে মৃত্যুর হার আছে আগের মতোই। বিগত এক সপ্তাহ থেকে মৃত্যু প্রতিদিন ২৯ থেকে ৪১ জনে ওঠানামা করছে।গতকালের প্রেস বিজ্ঞতিতেও স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪১ জন আর আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৮৯২ জন।

তবে সংক্রমণের এই কমে আসায় খুশি হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য না থাকলেও অনেক স্বাস্থ্য বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন, সামনে শীত আসছে। সেই সঙ্গে নতুন করে বাড়ছে করোনা-আশঙ্কাও। পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে তারা বলছেন, শীতল আবহাওয়ায় বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। তাদের ভাষ্য, সংক্রমণের গতি কিছুটা ধীর হয়েছে। তবে রোগী শনাক্তের হার এখনো অনেক বেশি।

জনসংখ্যার অনুপাতে নমুনা পরীক্ষাও কম হচ্ছে। এতে প্রত্যন্ত গ্রামে ও শহরের কিছু অঞ্চলে সন্দেহভাজন অনেকে পরীক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। আবার সংক্রমণ ঠেকানোর কার্যকর কোনো উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে প্রায় সবকিছু খুলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদদের আশঙ্কা, একটি দীর্ঘমেয়াদি সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো সুযোগ নেই। যেকোনো সময় সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। শীতকালে ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ। মানুষের মধ্যে সর্বজনীন মাস্ক ব্যবহার, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, হাত ধোয়ার অভ্যাস বাড়ানো এবং পরীক্ষা ও আইসোলেশনের মতো স্বাস্থ্যবিধির কঠোর প্রয়োগের ওপর এ রোগের বিস্তার অনেকটা নির্ভর করবে।

সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক তথ্য না থাকলেও অনেকেই আশঙ্কা করছেন, শীতকালের আবহাওয়ায় বাংলাদেশে সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। তাদের আশঙ্কা, আর্দ্রতা, সূর্যের তাপ, ভিটামিন ডি’র অভাব এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ শীতকালে অন্যান্য ভাইরাস ও ফ্লু জাতীয় শ্বাসকষ্টের রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।

তাই এ সময় মানুষ করোনা ভাইরাস নিয়ে আরো বেশি সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে। এদিকে শুরুর দিকে করোনা ভাইরাস নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ভয়ভীতি ছিল, এখন তা আর নেই বলেই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। মানুষ অনেকটা বেপরোয়াভাবে চলাফেরা করছে। মানুষের এই ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়ার আশঙ্কা তৈরি করছে।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এবং খ্যাতিমান মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে করোনা সংক্রমণ এখন কিছুটা কমতির দিকে। কিন্তু এখন কম-বেশি বলা মুশকিল। এক মাস পরিস্থিতি দেখে বলা যাবে, কোন দিকে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এখন তো টেস্ট কম হচ্ছে, তাই শনাক্ত কম হচ্ছে। জনগণও টেস্ট করাতে অহীনা দেখাচ্ছে। টেস্ট যদি বেশি বেশি করানো হয় তাহলে বোঝা যাবে করোনা কমছে কি না।’

আগামী শীতে সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘এটা বলা মুশকিল। করোনা নিয়ে তো আমাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। যখন আমাদের দেশে করোনা শুরু হয় তখন শীতকাল ছিল না। তবে তখন চীন এবং পশ্চিমা দেশগুলোতে শীত ছিল, সেখানে সংক্রমণও বেড়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বাংলাদেশেও সংক্রমণ বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।’

হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী মানবকণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ এখনো পুরোটা নিয়ন্ত্রণে আসেনি, এমতাবস্থায় অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে অফিস-আদালত, কল-কারখানা, যানবাহন সব কিছু খুলে দেয়া হয়েছে।

একই সঙ্গে মানুষের মধ্যে করোনার স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। মাস্ক ছাড়াই মানুষের চলাচল যেমন বেড়েছে, তেমনি মানুষের মধ্যে নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখতে অনীহা দেখা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ নিম্নমুখী, ঊর্ধ্বমুখী বা একই ধারায় প্রবহমান- এটা বোঝার জন্য যতসংখ্যক টেস্ট হওয়া দরকার সেটি হচ্ছে না। যে পরিমাণ কমিউনিটি জরিপ হওয়া দরকার সেটিও হচ্ছে না। ফলে এই পরীক্ষা দিয়ে করোনার গতি-প্রকৃতি, ধরন বলা সম্ভব নয়।

আমরা একটা জিনিস বুঝতে পারছি, মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং মৃত্যুবরণও করছে। আমরা করোনায় মৃত্যুর যে খবর পাই, সেখানেও সমগ্র দেশের সব হাসপাতালের মৃত্যুর খবর আসে না। শুধু দেশের সরকারি কিছু হাসপাতালের মৃত্যুর খবর পাই। ফলে এই অপ্রতুল তথ্য থেকে করোনা ভাইরাসের বর্তমান পরিস্থিতি বলা সম্ভব নয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ঢিলেঢালা ভাব ও মানুষের মধ্যে অচেতনতার ফলে যেকোনো সময় করোনার সংক্রমণ হু হু করে বেড়ে যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশেই আমরা করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার এমন দৃশ্য দেখেছি। বাংলাদেশে সেটা হলে দুঃখজনকভাবে হলেও আমাদের অনেক জীবন দিয়ে, ভোগান্তি দিয়ে ও অর্থনীতির ক্ষতি দিয়ে সেই মূল্য চুকাতে হবে।

ডা. লেলিন আরো বলেন, ‘আমাদের দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখন বলেন, করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে, তখন জনগণের মধ্যে থেকে করোনা-ভীতি কমাটাই স্বাভাবিক। করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যে কার্যক্রম চালু রাখা দরকার সেটা আমরা করছি না। করোনাকে আমরা তার নিজের মতো করেই চলতে দিচ্ছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ যেন নিজ থেকেই কমে যাবে!’

করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দেশের করোনা সংক্রমণ একদিন বাড়ে, একদিন কমে- এটা দেখে ভালো অবস্থা বলা যাবে না।

সামনে শীতকাল। শীতে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে বলা যাবে না। শীতকে সামনে রেখে কর্মপরিকল্পনা জরুরি।’তিনি বলেন, ‘আমরা লকডাউনে ব্যর্থ হয়েছি। এখন সবকিছু খুলে দিয়েছি। তাই সবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। বিশেষ করে মাস্ক ব্যবহার করতেই হবে। নইলে সামনে বিপদ চলে আসতে পারে।’

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এরপর মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াতে থাকে। জুনে তা তীব্র আকার ধারণ করে। জুলাইয়ের শুরু থেকে পরীক্ষা কমানোয় নতুন রোগী শনাক্তের সংখ্যাও কমতে থাকে। কিছুদিন ধরে শনাক্তের হারও কিছুটা কমেছে। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, যেসব নির্দেশকের মাধ্যমে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি না বোঝা যায়, তার কোনোটিই দেশে দেখা যাচ্ছে না।

নতুন রোগীর সংখ্যা, পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ও মৃত্যুর তথ্য বলছে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ থেকে বাংলাদেশ এখনো দূরে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী চিহ্নিত হওয়ার পর সংক্রমণের হার ‘পিকে’ বা শীর্ষে পৌঁছতে আড়াই থেকে তিন মাস সময় লাগতে দেখা গেছে। বাংলাদেশে শুরুতে বলা হয়েছিল এপ্রিলে সংক্রমণের পিক দেখা যাবে, পরে বলা হয় সেটি হবে মে মাসে।

কিন্তু জুন এবং জুলাই মাসেও সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এরপর কখন বাংলাদেশ সংক্রমণের শীর্ষ অবস্থানে অর্থাৎ পিকে উঠেছে, সে বিষয়ে কোনো সরকারি ঘোষণা দেখা যায়নি। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সরকার দাবি করছে বাংলাদেশে সংক্রমণের হার এখন নিম্নগামী। করোনার ৬ মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যুর চিত্র: গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম তিনজনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়।

এর ৩২ দিনের মাথায় ৮ এপ্রিল আক্রান্ত ২১৮ জনে পৌঁছায়। একই সঙ্গে মৃত্যু হয় ২০ জনের। ৬২ দিনের মাথায় ৮ মে মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১৩ হাজার ১৩৪ জনে এবং মৃতের সংখ্যা ২০৬ জনে পৌঁছায়। অর্থাৎ দ্বিতীয় মাসে ১২ হাজার ৯১৬ জন আক্রান্ত হয়। মৃত্যুবরণ করে ১৮৬ জন। সংক্রমণের ৯৩ দিনের মাথায় ৮ জুন মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬৮ হাজার ৫০৪ এবং মৃতের সংখ্যা ৯৩০ জনে পৌঁছায়। অর্থাৎ সংক্রমণের তৃতীয় মাসে ৫৫ হাজার ৩৭০ জন আক্রান্ত হয়।

একই সঙ্গে মারা যায় ৭২৪ জন। সংক্রমণের ১২৩ দিনের মাথায় ৮ জুলাই মোট আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ৭২ হাজার ১৩৪ জন এবং মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ১৯৭ জনে পৌঁছায়। অর্থাৎ সংক্রমণের চতুর্থ মাসে এক লাখ তিন হাজার ৬৩০ জন আক্রান্ত হয়।

এ মাসে মারা যায় এক হাজার ২৬৭ জন। সংক্রমণের ১৫৪ দিনের মাথায় ৮ আগস্ট মোট আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ৫৫ হাজার ১১৩ জন এবং মৃতের সংখ্যা তিন হাজার ৩৬৫ জনে পৌঁছায়। অর্থাৎ সংক্রমণের পঞ্চম মাসে ৮২ হাজার ৯৭৯ জন আক্রান্ত হয় এবং মারা যায় এক হাজার ১৬৮ জন।

সংক্রমণের ১৮৫তম দিনের মাথায় গত ৮ সেপ্টেম্বর মোট আক্রান্তের সংখ্যা তিন লাখ ২৯ হাজার ২৫১ জন এবং মৃতের সংখ্যা চার হাজার ৫৫২ জনে পৌঁছায়। সংক্রমণের ষষ্ঠ মাসে ৭৪ হাজার ১১৮ জন আক্রান্ত এবং মৃত্যুবরণ করে এক হাজার ১৮৭ জন। দেখা যাচ্ছে, চতুর্থ ও পঞ্চম মাসের তুলনায় ষষ্ঠ মাসে এসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমেছে।

খবর সারাবেলা / ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ / এমএম