করোনা যা কেড়ে নিয়েছে, যা নিতে পারেনি

করোনাভাইরাসের আক্রমণকে ভয় পাওয়ার মূল কারণটা কি মৃত্যুভয় নাকি সংক্রমণের ভয়? গত মে মাসের শেষ দিকে পশ্চিমবঙ্গের একজন নামকরা গাইনির ডাক্তার ডা. সন্তোষ চক্রবর্তীকে আমি এ প্রশ্নটি করেছিলাম। তিনি আমাকে মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠান। তাতে গত ২৭ মে’র এক পরিসংখ্যানে বিশ্বব্যাপী বিগত ৩ মাসে মৃত্যুর একটি চিত্র পাওয়া গেছে।

সেখানে আমরা দেখছি, করোনায় মারা গেছেন প্রায় ৩ লাখ পনের হাজার মানুষ; কমন কোল্ড-এ মারা গেছেন প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার; ম্যালেরিয়ায় মারা গেছেন ৩ লাখ ৪০ হাজার মানুষ; আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ৩ লাখ ৫৪ হাজার জন; সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৩ লাখ ৯৩ হাজার মানুষের; এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২ লাখ ৪০ হাজার মানুষ; মদ্যপানে ৫ লাখ ৫৮ হাজার, ধূমপানে ৮ লাখ আর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন প্রায় ১১ লাখ ৬০ হাজার। মৃত্যুর এ ৯টি কারণের মধ্যে করোনার স্থান অষ্টম। তিনি তথ্যসূত্র ব্যবহার করেননি।

তবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, সংক্রমিত হওয়াটাই বিশেষ ভয়ের কারণ। অপরাপর যে রোগগুলোর কথা বলা হল তাতে মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র তেমন একটা বিচলিত হয়ে পড়ে না, জনসাধারণও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন না; অথচ করোনাভাইরাস পৃথিবীর ৭৭৭ কোটি মানুষকে আতঙ্কিত করে ফেলেছে; জনজীবনের গতি-প্রকৃতি তছনছ করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল এ থেকে মুক্তির সম্ভাব্য দিনক্ষণ কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না।

অন্যান্য রোগে মরার আগে কেউ মরে না, আর করোনায় মানুষ মরার আগেই যেন মরে যাচ্ছে- চারদিকে শুধুই আতঙ্ক আর আতঙ্ক! করোনাভাইরাস বিশ্ববাসীকে হুমকি দিয়ে বলেছে, ‘আমাকে নিঃশেষ করার চেষ্টা না করে আমার সঙ্গে মানিয়ে জীবন ধারার পরিবর্তন কর।’উৎসবের দেশ বাংলাদেশ। এখানে বিভিন্ন উৎসব এতকাল ধরে আনন্দঘন পরিবেশে পালিত হয়ে আসছে। সেসব আয়োজনকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে করোনাভাইরাস। উৎসববিহীন বাঙালি, আমাজানবিহীন পৃথিবী আর ফুসফুসবিহীন মানবদেহ সমার্থক।

আমরা আমাদের জীবনচলার পথ পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। অর্থনীতির ক্ষেত্রে আমরা পশ্চিমা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অনুসরণ করছি; কিন্তু আমাদের অর্থনীতি যতখানি পুঁজিবাদের দিকে এগিয়েছে সমাজব্যবস্থা ততখানি এগোয়নি। পুঁজিবাদের যে ‘নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি’র চল রয়েছে তার ছিটেফোঁটা এখানেও বর্তমান থাকলেও সামগ্রিক একটা পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে দৃশ্যমান ছিল। করোনা সে দৃশ্য পাল্টে দিয়েছে। আমাদের সমাজ বহুকাল থেকেই অতিথিপরায়ণ; গত ৪ মাসে তা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমরা এখন কেউ আর কারও বাড়িতে যাই না।

কোনো বিশেষ কাজে কেউ যদিওবা কারও বাড়িতে আসে, তা সে যত কাছের আত্মীয়ই হোক, এমনকি এক মায়ের পেটের ভাইবোন- আলাদা আসনে বসতে দিই; আসন ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আসনটিকে স্যানিটাইজ করি। এটি নিশ্চয়ই বাস্তবতার নিরিখে বিজ্ঞানসম্মত; কিন্তু অন্তরে বাস করা আবেগ-অনুভূতিতে রক্তক্ষরণ ঘটে। আমরা এখন ষোলআনাই কামনা করি, কেউ যেন আমার বাড়িতে না আসে এবং কারও বাড়িতে না যাওয়ার সিদ্ধান্তও স্থির করে ফেলেছি। করোনা আমাদের একা করে দিয়েছে।

৬ বছরের সন্তান করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে, তার গালে স্নেহের পরশে আলতো চুমু খাওয়া বারণ; করোনা সে সুযোগ কেড়ে নিয়েছে। ছোটবেলায় মাতাপিতাকে হারানোর কথা ভাবতেই পারিনি। বড় হয়ে বুঝতে পারলাম, দুনিয়াতে কেউ চিরদিন বেঁচে থাকে না এবং তা মেনেও নিয়েছি। করোনা আমাদের সব অনুভূতিকে বিনাশ করে হৃদয়কে পাথর বানিয়ে ফেলেছে। এমন মর্মান্তিক বাস্তবতার চিত্র আমরা কল্পনাতেও কোনোদিন আঁকতে পারিনি।

জীবন আর জীবিকা সমার্থক নয় তবে পরিপূরক; জীবন ছাড়া জীবিকা অচল, জীবিকা ছাড়া জীবন বিফল। করোনা মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাকে লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন করে বাংলাদেশে বেকার হওয়া মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লাখ পেরিয়ে যেতে পারে; ৬ কোটি কর্মজীবীর দেশে তা ২৫ শতাংশ। আর্থিক জীবনে শ্রেণি বা বিত্তচ্যুতি ঘটে চলেছে। মধ্যবিত্ত-নিুবিত্তে আর নিুবিত্ত দরিদ্রের কাতারে নেমে এসেছে। করোনাপূর্বকালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল কম-বেশি ২৪ শতাংশ।

গবেষকরা বলছেন, আর ২ মাস এ অবস্থা চলতে থাকলে দারিদ্র্যসীমা ৪২ শতাংশ অতিক্রম করতে পারে। স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীরা পথে বসার উপক্রম হয়েছে। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোতে খাদ্যে সুষম পুষ্টি বজায় রাখা দায় হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস আমাদের জীবনের নিরাপত্তাকে কেড়ে নিয়েছে; আমাদের সার্বিকভাবে সর্বস্বান্ত করেছে।

তবে হ্যাঁ, আমাদের চরিত্রের নেতিবাচক দিকগুলোকে করোনা আঘাত করতে পারেনি। করোনার রূপটি যখন আমাদের চিন্তনে প্রকটভাবে ধরা পড়েনি, সেই শুরুতেই একটি ৩০ টাকা দামের মাস্কের দাম হয়ে গেল ১০০ টাকা বা ১৫০ টাকা। তার মানে অসৎজনরা করোনাকে মোকাবেলার চিন্তা না করে তা থেকে ফায়দা লোটার তালে ছিল। চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহের বেলায়ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মান রক্ষা করা হল না। এ বিষয়ে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

চিকিৎসকরা আমাদের কাছে চিরকালই শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন; কিন্তু করোনা-পূর্ববর্তী সময়গুলোতে অনেক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের নানা রকম অভিযোগ ছিল। বিশেষ করে প্যাথলজিক্যাল টেস্ট থেকে এসব চিকিৎসকের ৪০ শতাংশ কমিশন নেয়াকে সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখতেন না; কিন্তু করোনাকালে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবনবাজি রেখে কাজ করার প্রত্যয় তাদেরকে আবারও শ্রদ্ধার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

পরিতাপের বিষয় হল চিকিৎসকদের প্রতি মানুষের সেই শ্রদ্ধা- শিখায় জল ঢেলে দিলেন জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী ও তার স্বামী আরিফ চৌধুরী। করোনা সমস্যাকে পুঁজি করে এ প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ভুয়া টেস্ট রিপোর্ট প্রদানের মাধ্যমে ৫ কোটি টাকারও বেশি হাতিয়ে নেয়। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে এবং সাবরিনা ও তার স্বামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা মনে করি শক্তিশালী অদৃশ্য হাত ছাড়া ডা. সাবরিনা এতদূর এগোতে সাহস পেতেন না।

আমার এ কথার পক্ষে যুক্তি হল, করোনা মোকাবেলায় যে সময়ে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজকে মাত্র ১০০ মাস্ক ও ১০০ পিপিই এবং ঢাকার মুগদা মেডিকেল কলেজকে মাত্র ২৫টি মাস্ক ও ২৫টি গগলস দেয়া হল একই সময়ে ডা. সাবরিনার জেকেজিকে দেয়া হয়েছিল ১২০০ পিপিই, ১২০০ গগলস, ৩ হাজার সার্জিক্যাল মাস্ক এবং ৩ হাজার হ্যান্ড গ্লাভস। এতবড় সুযোগ কীসের বিনিময়ে অর্জিত হল?

প্রতারণা, জালিয়াতিসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বেলায় করোনা আমাদের কাছে হেরে গেছে। করোনাপূর্বকালে ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের গডফাদারদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছিল। সম্রাট, জিকে শামীম গণমাধ্যমকে ভীষণভাবে ব্যস্ত রেখেছিলেন। তার ক’মাস বাদেই আমাদের চোখের সামনে এলেন পাপিয়া নামের আরেক আন্ডারওয়ার্ল্ড সম্রাজ্ঞী; অনেক প্রভাবশালীকে মাতিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছিলেন।

প্রতারণা ও অনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলতে পারেনি করোনা; এর প্রমাণ প্রতারক মো. সাহেদ করিম। মিডিয়ায় ঝড় তুলে দিয়ে এ প্রতারক ‘কিংবদন্তি’ এখন লাল ঘরে। রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিমকে করোনা টেস্টে জালিয়াতির জন্য গ্রেফতার করা হয়। ধারণা করা হয়, সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে আনুমানিক ৬ হাজার ভুয়া সনদ দেয়া হয়েছে।

সাহেদ করিম করোনাপূর্ব অবস্থায় প্রতারণা করে যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছেন তার তুলনায় ভুয়া সনদ দিয়ে কামানো অর্থ অতি সামান্য। তারপরও কেন তিনি তা করলেন? কারণ, তার জীবনে প্রতারণা একটা নেশা, এখানে কম-বেশি লাভের কোনো গুরুত্ব নেই। সাহেদ ক্ষমার অযোগ্য এতে সন্দেহ নেই; কিন্তু যাদের সহযোগিতায় সাহেদ এ ‘মহীরুহ’ মূর্তি ধারণ করতে পেরেছে, মানুষ তাদের নাম জানতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক।

২০১৪ সালের পর রিজেন্ট হসপিটাল তার কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি নবায়ন করেনি- অর্থাৎ বর্তমান কার্যক্রম আইনগতভাবে বৈধ নয়। এমন একটি অবৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে করোনা মহামারীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কীভাবে চুক্তি হল? এমনতর প্রশ্নের উত্তর কৌশলে এড়িয়ে যেতে পারলেও মানুষের অন্তর থেকে মুছে ফেলা যাবে না।

আমাদের মানতেই হবে, সম্রাট, জিকে শামীম, পাপিয়া, ডা. সাবরিনা, সাহেদ করিম- এরা হচ্ছেন ‘প্রডাক্ট অব দ্য সিস্টেম’। ব্যক্তিগতভাবে তারা হয়তো আর লাইম লাইটে আসবেন না; কিন্তু কালকেই আবার একজন সাহেদের পরিবর্তে অন্য একজন জেগে উঠবেন। যত বড় করোনা ঝড়ই আসুক, যতদিন পর্যন্ত পদ্ধতির গুণগত পরিবর্তন না হবে, ততদিন পর্যন্ত এদের আগমন ও বেড়ে ওঠা চলতেই থাকবে।

খবর সারাবেলা / ২০ জুলাই ২০২০ / এমএম