করোনাকালের জীবনযাত্রায় বিপর্যস্ত শিশুরা

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস মানুষের জীবন যাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। এই করোনাভাইরাসের কারণে প্রত্যেক স্তরে কিছু না কিছু মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হয়েছে শিশুরা। আর গ্রামের তুলনায় শহরের শিশুদের ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার হারই বেশি। টানা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।

গ্রামের শিশুদের বাড়ির আঙিনা মাড়ানোর সুযোগ থাকলেও শহরের শিশুরা সে সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। চারদেয়ালে বন্দিজীবন কাটাতে হচ্ছে তাদের। লকডাউনের কবলে বারবার বন্ধ হচ্ছে দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোও। তাই চাইলেও কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ নেই। এই আবদ্ধ থাকার ফলে নানান বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিশুদের মনে। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘‘দীর্ঘ এ আবদ্ধ জীবনের কারণে শিশুদের সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাহত হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে অন্তর্মুখিতা তৈরি হচ্ছে। তারা যত অন্তর্মুখী হচ্ছে তাদের মধ্যে স্নায়ুবিক উদ্বেগ তত বাড়ছে।’’

শিশুসাহিত্যিক রাশেদ রউফ বলেন, ‘‘এই আবদ্ধ সময়ে শিশুদের যদি তাদের পছন্দ অনুযায়ী সৃজনশীলতা চর্চার সুযোগ করে দেওয়া যায় তাতে কিছুটা হলেও তাদের মানসিক বিকাশ হবে। যেমন, কোনো গল্প বা ছড়ার বই পড়তে দেওয়া, নাচ গান বা নৃত্যের চর্চা করা এবং নতুন কোনো ভাষা বা এমন কিছু শেখার সুযোগ করে দেওয়া।’’

দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় পড়াশোনার সাথে সম্পর্ক নেই বেশিরভাগ শিশুর। তাদের দৈনন্দিন জীবন অনিয়মে কাটছে বলে অভিযোগ অনেক অভিভাবকের। স্কুল না থাকায় সকালে তাড়া নেই। তাই অনেক শিশুই দেরিতে ঘুমুচ্ছে এবং অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠছে। এতে শিশুদের স্বাস্থ্যহানি হচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি জরিপ থেকে জানা যায়, এই বন্ধে ৯০ শতাংশ শিশুর স্কুল থেকে লেখাপড়ার কোনও খবর নেওয়া হয়নি। ৯১ শতাংশের বাড়িতে পড়াশোনায় সাহায্য করার মতো কেউ নেই এবং ২৩ শতাংশ শিশু বাসায় একেবারেই পড়ালেখা করছে না।

আবার দীর্ঘ সময় স্কুল থেকে দূরে থাকার ফলে অনেক শিশুর মনে স্কুলের কিংবা পড়াশোনার প্রতি অনীহা চলে আসায় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো কাজে পাঠিয়ে দিচ্ছে শিশুদের। মফস্বলে এটি বেশি ঘটছে বলে মনে করেন সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার কাড়াবাল্লা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এনায়েত হোসাইন।

২০২০ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি তোমো হোজুমি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, ‘‘অন্যান্য দেশের জরুরি অবস্থার অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, শিশুরা যত বেশি সময় স্কুল থেকে দূরে থাকে, তাদের স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কমে যায়।”

অনেক পরিবারে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে কমবেশি ঝগড়া কলহ হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তালাক পর্যন্ত গড়ায় ব্যাপারটা। কোভিড-১৯ এর এই ঘরবন্দী সময়ে এই হারটা অনেক বেড়েছে। এর প্রভাব পড়ছে শিশুদের মনেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব বলেন, ‘‘বাবা মায়ের মধ্যে কলহ কিংবা সম্পর্কের অবনতিতে একধরনের মানসিক চাপ অনুভব করে শিশুরা। তাদের মনে শঙ্কা কাজ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী।’’তিনি বলেন, ‘‘এর থেকে মুক্তি পেতে বাবা-মাকে সচেতন হতে হবে। যত সমস্যাই থাকুক না কেন, তা শিশুদের সামনে না নিয়ে আসাই ভালো।’’

এই অখণ্ড অবসরে অনেক শিশুর ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে গড়ে উঠেছে বেশ সখ্যতা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটা কাজে এলেও এই সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। স্মার্টফোন, ট্যাব এবং ল্যাপটপে গেম খেলে আর ভিডিও দেখে সময় কাটছে বেশিরভাগের। অনেক অভিভাবকে না চাইলেও স্কুলের অনলাইন ক্লাসের জন্য ডিজিটাল ডিভাইস হাতে দিতে হয় শিশুদের। এই সুযোগে অনেকে ঝুঁকে যায় ডিজিটাল ডিভাইসের প্রতি। সিলেটের এক অভিভাবক সুমাইয়া মাহজাবিন অভিযোগের সুরে বলেন, ‘‘এই আবদ্ধ সময়ে আমার বাচ্চার অনেক সময় কাটে মোবাইলে ইউটিউব ভিডিও দেখে আর গেম খেলে। জোর করেও ওকে মোবাইল থেকে সরিয়ে রাখতে পারি না।’’

অপরিণত বয়সে এমন আসক্তিকে শিশুসাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রামের চাইল্ড কেয়ার হসপিটালের মেডিকেল অফিসার ড. তাসনিম মুনিয়াত আনসার। তিনি বলেন, ‘‘দীর্ঘক্ষণ ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহারে শিশুরা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যায়, ফলে রেগে যায় সহজে। কোনো কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না। বাস্তব জগতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়, এবং ঠুনকো কারণে তাদের মন খারাপ হয়ে যায়।’’

কোভিড-১৯ এর প্রভাবে অনেক অভিভাবক চাকরি হারা হচ্ছেন। ক্ষুদ্র থেকে অনেক বৃহৎ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদেরও লোকসান গুনতে হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষেরা বেশি সমস্যার সম্মুখীন। যার প্রভাব পড়ছে ঘরের শিশুদের ওপরও। করোনার সময়ে এমন চিত্রও মিডিয়ায় এসেছে যে, অনেক বাবা তাঁর কোলের শিশুর জন্য দুধটাও আনতে পারছেন না। এভাবে অনেক পরিবার শিশুর জন্য পরিমিত খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে অপুষ্টিতে ভুগছে অনেক শিশু। সেভ দ্য চিলড্রেনের ওই জরিপে বলা হয়, চরম খাদ্য সংকটে আছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৬৪ শতাংশ শিশুর পরিবার।

কোভিড-১৯ এর কারণে অনেক পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়েই শ্রমে নামতে হচ্ছে অনেক শিশুকে৷ করোনার এই সময়ে শিশুশ্রম নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে কোনো গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি। ফলে শিশু শ্রমিকদের বর্তমান সংখ্যাটা জানা যায়নি। তবে সর্বশেষ ২০১৩ সালে পরিচালিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ৩৪ লাখ শিশু বিভিন্নরকম কাজে কর্মরত ছিল। এর মধ্যে ১৭ লাখ শিশুর কাজ শিশুশ্রমের আওতাভুক্ত।

এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত ছিল ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। এবং ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেছে। তবে ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ এর প্রভাবে আরও লাখ লাখ শিশু ঝুঁকিতে রয়েছে। বৈশ্বিক এ পরিসংখ্যানকে সামনে রেখে বাংলাদেশেও শিশু শ্রমিকদের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে বেড়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, ‘‘শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি এবং গত বছরটি এই লড়াইকে কোনোভাবে সহজতর করে তোলেনি। এখন বিশ্বব্যাপী লকডাউন, স্কুল বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন এবং জাতীয় বাজেট ক্রমেই সংকুচিত হওয়ার দ্বিতীয় বছরে অনেক পরিবার হৃদয়-বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।’’

কোভিড-১৯ এর এই সংকটকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি কষ্টে আছে পথশিশুরা। মহামারি থেকে বাঁচতে যখন বলা হচ্ছিল ‘ঘরে থাকুন, সুস্থ থাকুন’ তখনও কোথাও মাথাগোঁজার ঠাঁই হয়নি তাদের। খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ কোনো ধরনের সেবার আওতায় নেই পথশিশুরা। শিশুদের যতরকম ঝুঁকি থাকতে পারে তার সবই রয়েছে পথশিশুদের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে পথশিশুদের সংখ্যা কত তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।

পথশিশুদের সংখ্যা নিয়ে ২০১৯ সালে ডয়েচে ভেলে বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার পরিচালনা সেক্টরের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘‘সেরকম নিবিড়ভাবে করা কোনো পরিসংখ্যান আসলে বাংলাদেশে নেই যে যেখান থেকে বোঝা যাবে। কিন্তু বিভিন্ন খন্ডিত গবেষণা থেকে ধারণা করা হয় বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা আড়াই লাখ থেকে চার লাখ হতে পারে৷’’ এ সংখ্যাটা যতোই হোক, তারাই এই মহামারিতে সবচেয়ে বেশি অসহায়।

তবে কোভিড-১৯ এর এই সময়ে অনেক সচেতন অভিভাবক শিশুদের দিকে বিশেষ নজর রাখছেন। তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন। এমন পরিবারের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।

খবর সারাবেলা / ৩১ আগস্ট ২০২১ / এমএম