ইঁদুরের মৃত্যুশোক
অনেক অনেক আগে দু’টি ইঁদুর ছিল। ‘টিটি মূষিক’ ও ‘ট্যাটি মূষিক’ ছিল তাদের নাম। দুই ইঁদুরে ছিল বেশ সখ্য। তারা একইসঙ্গে একই বাড়িতে থাকত। একদিন টিটি খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল। ট্যাটি ঘরে বসে না থেকে সেও খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ল।
দু’জনই খাবার আনতে গেল। টিটি এক থোকা শস্যদানা নিয়ে বাসায় ফিরল। ট্যাটিও এক থোকা শস্যদানা নিয়ে বাসায় ফিরল। মানে, দু’জনই নিজেদের জন্য এক থোকা শস্যদানা নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। টিটি সেই শস্যদানা দিয়ে পুডিংয়ের মতো কিছু একটা বানাল। ট্যাটিও তাই করল। মানে, দু’জনই একই রকম খাবার বানাচ্ছিল। এবার সেই খামির আগুনে রান্না করার পালা।
পুডিংয়ের মতো দেখতে যে জিনিসটা ট্যাটি বানিয়েছিল সেটি সে একটি পাত্রে রাখল। সেই পাত্র চড়াল আগুনে, সিদ্ধ করবে বলে। টিটিও চাইল সিদ্ধ করে খাবে। টিটি আগুনে বসানো পাত্রে তার পুডিং দেওয়ার চেষ্টা করল। অমনি পাত্রসুদ্ধ উল্টে পড়ল একদম টিটির গায়ে। বেচারা টিটির আর খাওয়া হল না। ঝলসে পুরোপুরি মরেই গেল।
মুহূর্তেই সবটা ট্যাটির সামনে ঘটে গেল। ট্যাটি মাথায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বসল। এরপর গলা ছুড়ে বিলাপ শুরু করল। ট্যাটির বিলাপ শুনে ঘরের অন্যকোণ থেকে ছুটে এল তিন পায়াযুক্ত ছোট টেবিল। নাম তার তেপায়া। তেপায়া বলল, ‘ট্যাটি, তুমি কাঁদছো কেনো?’ ট্যাটি বলল, ‘কাঁদছি কি আর সাধে!
টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে।’ তেপায়া মৃত্যুর খবর শুনে বেশ মর্মাহত হলো। কিন্তু সেতো ট্যাটির মতো কাঁদতে পারে না। কিন্তু শোক প্রকাশে সামিল না হলে খারাপ দেখায়। ভেবেচিন্তে তেপায়া বলল, ‘ওমা! আমি তবে লাফাই’- বলেই তেপায়া লাফানো শুরু করল।
কক্ষের এককোণায় ছিল ঝাড়। তেপায়াকে লাফাতে দেখে বলল, ‘তেপায়, তুমি লাফাচ্ছ কেনো?’ তেপায়া বলল, ‘লাফাচ্ছি কি আর সাধে! টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে। কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা। তাইতো আমি লাফাচ্ছি।’ ঝাড়– এখন করবেটা কী? ঝাড়–ও খানিক ভাবল। এরপর সিদ্ধান্ত নিল। ‘ওমা! আমি তবে ঝাড় দেই’- বলেই ঝাড়– ঝাড় দেওয়া শুরু করল।
অসময়ে এবড়ো থেবড়ো ঝাড় দিতে দেখে দরজা বলল, ‘ঝাড়–, অবেলায় ঝাড় দেওয়ার সখ হল কেন?’ ঝাড়– বলল, ‘ঝাড় দিচ্ছি কি আর সাধে! টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে। কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা। তেপায়াকে দেখলাম লাফাচ্ছে। তাইতো আমি ঝাড় দিচ্ছি।’ ‘ওমা! আমি তবে খট খট শব্দ করি’- বলেই দরজা খট-খট, খট-খট শব্দ করতে লাগল।
দরজার খটখটানি শুনে জানালা বলল, ‘দরজা মশাই, খটখটানির কারণ বলবে একটু?’ দরজা বলল, ‘খটখটাচ্ছি কি আর সাধে! টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে। কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা। শুনলাম তেপায়া লাফাচ্ছে। ঝাড়–কে দেখলাম ঝাড় দিচ্ছে। তাইতো আমি খট-খট, খট-খট শব্দ করছি।’ ‘ওমা! আমি তবে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করি- বলেই জানালা ক্যাঁচক্যাঁচানি শুরু করল।
ঘরের বাইরে একটি পুরনো বেঞ্চ রাখা ছিল। জানালার ক্যাঁচক্যাঁচানি শুনে বলল, ‘জানালা, আর কাজ পেলে না তুমি?’ জানালা বলল, ‘ক্যাঁচক্যাঁচাচ্ছি কি আর সাধে! টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে। কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা। শুনলাম তেপায়া লাফাচ্ছে, ঝাড়– ঝাড় দিচ্ছে। দরজাকে দেখলাম খটখটাচ্ছে। তাইতো আমি ক্যাঁচ-ক্যাঁচ, ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ করছি।’ ‘ওমা! আমি তবে বাড়ির চারপাশে দৌড়াই’- বলেই বুড়ো বেঞ্চ বাড়ির চারপাশে দৌড়াতে লাগল।
বাড়ির পাশ ঘেষেই একটি আখরোট গাছ ছিল। যেমনি বিশাল তেমনি সুশ্রী। আখরোট গাছ বলল, ‘বুড়ো বেঞ্চের কাণ্ড দেখো! এইযে বুড়ো, বাড়ির চারপাশে অমন করে দৌড়াচ্ছ কেন?’ বেঞ্চ বলল, ‘দৌড়াচ্ছি কি আর সাধে! টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে। কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা।
শুনলাম, তেপায়া লাফাচ্ছে, ঝাড়– ঝাড় দিচ্ছে, দরজা খটখটাচ্ছে। জানালাকে দেখলাম ক্যাঁচক্যাঁচাচ্ছে। তাইতো আমি দৌড়াচ্ছি।’ ‘ওমা! আমি তবে পাতা ঝরিয়ে দেই’- বলেই আখরোট গাছ তার সব সবুজ পাতা ঝরিয়ে দিল।
আখরোট গাছে ছোট্ট এক পাখি আশ্রয় নিয়েছিল। গাছকে সব পাতা ঝরিয়ে দিতে দেখে বলল, ‘গাছ ভাই, পাতা কেনো ঝরালে?’ আখরোট বলল, ‘ঝরালাম কি আর সাধে! টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে। কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা। শুনলাম, তেপায়া লাফাচ্ছে, ঝাড়– ঝাড় দিচ্ছে, দরজা খটখটাচ্ছে, জানালা ক্যাঁচক্যাঁচাচ্ছে। বুড়ো বেঞ্চকে দেখলাম বাড়ির চারপাশে দৌড়ে হয়রান। তাইতো আমি পাতা ঝরিয়ে দিলাম।’ ‘ওমা! আমি তবে পালক খসিয়ে ফেলি’- বলেই পাখি তার সব সুন্দর পালক খসিয়ে ফেলল।
এমন সময় গাছের নিচ দিয়ে ছোট্ট এক মেয়ে যাচ্ছিল। তার হাতে ছিল জগভর্তি দুধ। এই দুধ সে তার ভাই-বোনকে রাতে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছিল। পাখিকে এমন অদ্ভুত কাণ্ড করতে দেখে মেয়েটি বলল, ‘ছোট্ট পাখি, সব পালকই কেনো খসিয়ে ফেললে?’ পাখি বলল, ‘খসালাম কি আর সাধে!
টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে। কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা। শুনলাম, তেপায়া লাফাচ্ছে, ঝাড়– ঝাড় দিচ্ছে, দরজা খটখটাচ্ছে, জানালা ক্যাঁচক্যাঁচাচ্ছে, বুড়ো বেঞ্চ বাড়ির চারপাশে দৌড়ে হয়রান। গাছকে দেখলাম সব পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়ো হয়েছে। তাইতো আমি পালক খসিয়ে ফেললাম।’ ‘ওমা! আমি তবে এইযে দুধ দিলাম ফেলে’- বলেই মেয়েটি জগ থেকে দুধ ফেলে দিল।
পাশেই এক বৃদ্ধ মইয়ে উঠে খড়ের গাদার ঘর ছাওয়ার কাজ করছিল। মেয়েটিকে দুধ ফেলে দিতে দেখে বলল, ‘এই যে অবুঝ মেয়ে, দুধ ফেলে কী বুঝাতে চাইছো? তোমার ছোট ভাই-বোন রাতে উপোষ থাকবে সে খেয়াল কি আছে?’ মেয়েটি বলল, ‘দুধ ফেলেছি কি আর সাধে! টিটি মরেছে ক্ষণকাল আগে।
কাঁদতে কাঁদতে ট্যাটির মরো মরো অবস্থা। শুনলাম, তেপায়া লাফাচ্ছে, ঝাড়– ঝাড় দিচ্ছে, দরজা খটখটাচ্ছে, জানালা ক্যাঁচক্যাঁচাচ্ছে, বুড়ো বেঞ্চ দৌড়ে হয়রান, গাছ পাতা ঝরিয়ে ন্যাড়ো হয়েছে। ছোট্ট পাখিকে দেখলাম পালক খসিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। তাইতো আমি দুধ ফেলে দিয়েছি।’ ‘ওমা! আমি তবে মই থেকে উল্টে পড়ে ঘাড় দেই ভেঙে’- বলেই বৃদ্ধ মই থেকে পড়ে গেল। অমনি বৃদ্ধের ঘাড় ভেঙে গেল।
বৃদ্ধের ঘাড় ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে বিশাল আখরোট গাছ মড়মড় করে ভেঙে পড়ল। এতে বুড়ো বেঞ্চ ও বাড়ি চুরমার হয়ে গেল। বাড়ি জানালাকে আঘাত করে ভেঙে দিল। জানালা দরজাকে ভ‚পাতিত করল। দরজা ঝাড়–কে তছনছ করে ফেলল। ঝাড়– তেপায়াকে লণ্ডভণ্ড করল। বেচারা ট্যাটি ধ্বংসস্ত‚পের নিচে চাপা পড়ল।
(মূল: ইংল্যান্ডের উপকথা, ইংরেজিতে পুনঃকথন: জোসেফ জ্যাকবস)
খবর সারাবেলা / ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ / এমএম