আসছে শীতের প্রস্তুতিতে
সকালে জানালা দিয়ে বাইরে চেনা সড়কের দিকে তাকান। কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া, আবছা। শীতের কুয়াশা আলতোভাবে জানান দিচ্ছে সে আসছে। বুড়ি থুরথুর করে আসছে। যেতে বড়জোর তিন মাস। অল্প কদিনের আসা। আবার ফিরে যাওয়া।
শীত নিয়ে অনেক রোমান্টিক ভাবনাই আমাদের মনে। এই ঋতু আসলে কত পরিকল্পনা। আবার এই শীতেই বড্ড যন্ত্রণা। প্রচণ্ড শীত হলে বাইরে যেতে খারাপ লাগে। আবার ঠাণ্ডা লাগলে তো কথাই নেই। হাঁচি, কফ, কাশি, জ্বর তো আছেই। তাই শীতের প্রস্তুতি দরকার। শীত মোকাবিলার জন্য একটু আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো। গরম জামা কাপড় থেকে শুরু করে ত্বকের পরিচর্যার উপাদান সবকিছুই আগেভাগে গুছিয়ে রাখলে সময়টা ভালো কাটে। পেইচিং প্রবীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা চিকিত্সা বিভাগের মহাপরিচালক ডাক্তার লিউ তে ছুয়ান বলেন, ‘শীতকালে দিন ও রাতের বিশ্রামের সংশ্লিষ্ট নিয়ম আমাদের মেনে চলা উচিত। এটি আমাদের শরীরকে সবচেয়ে ভাল অবস্থায় রাখার জন্য সহায়ক।’
কারণ স্বাস্থ্যই মূল সমস্যা না। সমস্যা হলো ত্বকেও প্রভাব পড়ে। তাই আপনাকে সতর্ক থাকতেই হবে। এই সতর্কতা অনেক জরুরি। শীতকালে যদি সুস্থ থাকতে চান, শীতকে যদি উপভোগ করতে চান তাহলে আমাদের সঙ্গেই থাকুন।
শীতে স্বাস্থ্যের যত্নের প্রস্তুতি
প্রথমেই আসে স্বাস্থ্য। শীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষার কিছু কমন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক। শীতে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কমে যায়। মূলত ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে সর্দি, কাশি, পেটে সমস্যা, জ্বর, ঠাণ্ডাজনিত গলাব্যথার মতো কিছু সমস্যা হয়ে থাকে। তাই শরীর গরম রাখার জন্য গরম কাপড়ের ব্যবস্থা রাখুন।
শীতে তৃষ্ণা কম লাগে। ফলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। পানি ঠাণ্ডা লাগে তা তো বোঝাই যাচ্ছে। পর্যাপ্ত স্যুপ ও জুস জাতীয় খাবার খান। আবার শীতকালে গরম চা, কফি ও অ্যালকোহল বেশ লোভনীয় পানীয়। এগুলো শরীর আর্দ্রতাশূন্য করে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ত্বকের যত্নে প্রথমেই পর্যাপ্ত পানি পান করার পরামর্শ দেন। শীতকালে ব্যায়ামের পর বা অন্য সময়েও হালকা গরম পানি বা কোমল পানীয় পান করুন। গরম পানীয় শরীর দ্রুত শুষে নেয় শরীরে।
শীতে প্রতিদিন খাবারের তালিকায় রাখার চেষ্টা করুন ভিটামিন সি-যুক্ত খাবার। টাটকা ফল ও সবজিতে আছে বায়োটিন, যা ত্বক ও চুল ভালো রাখে। শীতে অনেক সবজি পাওয়া যায়। তাই সমস্যা নেই।
এই ঋতুতে সকালে অনেকে দেরিতে ওঠেন। অর্থাৎ নাস্তার সময়ও অনেকটা পিছিয়ে যায়। সকালে উঠে খালি পেটে পানি পান করুন। চিরতার রসও খেতে পারেন। তারপর দ্রুত নাস্তা করুন।
শীতে বিশেষ করে বয়স্কদের বাঁতের সমস্যা অনেক বেড়ে যায়। বিশেষত রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, এনকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস, অস্টিও- আর্থ্রাইটিস এই সমস্যা বেশি মাথাচাড়া দেয়। এর কারণ শীতে অনেকে চলাচল সঠিকভাবে করেন না। ফলে তাদের এই সমস্যা হয়। এ জন্য যথাসম্ভব গরম কাপড় পরা, মোজা পায়ে রাখা, ব্যথার স্থানে হালকা গরম সেক দেওয়া। ঘরেই নড়াচড়া করুন।
যাদের শারীরিক সমস্যা আছে তাদের পানি বারবার ব্যবহার না করাই ভালো।
শীতে বিশেষ করে ভোরের দিকে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ-রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্তদের ঝুঁকি এই সময় বেশি থাকে।
তাই এই শীতে কুয়াশার মধ্যে না হেঁটে, একটু রোদ উঠলে হাঁটাহাঁটি করা উচিত।
তীব্র শীতের আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হলো হাইপোথার্মিয়া। এই সমস্যায় অনেকে মারাও যায়। হাইপোথার্মিয়া সম্পর্কে জেনে নিন এবং যখন লক্ষণ দেখবেন দ্রুত গরম কাপড় পরান রোগীকে অথবা গরম পরিবেশ তৈরি করুন।
শীতে শারীরিক সমস্যা থেকে বাঁচতে কুসুম গরম পানি পান করুন।
শীতের কাপড় ও অন্দর
শীতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ কাপড় ও অন্দর। অন্দরে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরিবেশ বদলায়। তাই কিছু বেসিক জিনিস জানা জরুরি।
শীত আসার আগেই কাপড় কিনে নিন। শীত আসলে বাজারে দাম হু হু করে বেড়ে যায়। চীনারা শীত পছন্দ করে না কারণ স্টাইলিশ পোশাক পরা যায় না। তবে আমাদের সে আয়েশ নেই। শীতে উপযুক্ত পোশাকই বাছাই করুন। শীতকালে পর্দার আবশ্যকতা না বললেই নয়। শীতকালে পর্দা যেমন বাইরের ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকতে দেয় না, তেমনি ঘরকে গরম রাখতেও সহায়তা করে। তাই শীতের সময় ঘরের উষ্ণতা বজায় রাখতে নির্বাচন করতে হবে ভারী, ঘন বা জমকালো নকশার পর্দা। পর্দার জন্য ভারি ও মোটা কাপড় বাছাই করুন। শীতে কাপড় কিনে আলাদা একটি কাবার্ডে রাখুন। যত্ন নিন। লেপ, কম্বল বা শীতের প্রস্তুতির জন্য চাদর বের করে রোদে দিন। খেয়াল করুন কোথাও পোকা আছে কি-না। রোদে দিলে কাপড় ঠিক হবে।
অনেকে শীতে কাপড় বা অন্যান্য জিনিস পরিষ্কার করেও ভালোভাবে সংরক্ষণ করেন না। ফলে ধুলো বা ময়লা জমে সমস্যা হয়। সেক্ষেত্রে পরিষ্কার আগেই করে নিন। ঘরের আসবাব শীতের আর্দ্রতায় সমস্যায় পরতে পারে। আগে থেকেই বার্নিশ করিয়ে নিন।দেয়াল বা কোথাও ফাটল বা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব থাকলে দ্রুত সারিয়ে নিন। ঘরে হিটারের ব্যবস্থা করতে পারেন। ওয়াটার হিটারও রাখতে পারেন।
শীতে আপনার খাদ্যাভ্যাস
শীতে খাদ্যাভ্যাসের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি। কোনগুলো খাবেন আর কোনগুলো খাবেন না বোঝা। সেক্ষেত্রে যা করবেন।
শীতকালীন খাবার হিসেবে মাশরুম খান। এতে ভিটামিন বি, সি, ডি এবং ক্যালসিয়াম,পটাশিয়াম, মিনারেল, আরগোথিওনিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।শীতের সময় ডায়েটে রাখুন প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি। এগুলোতে থাকা পুষ্টি আমাদের সুস্থ রাখে।শীতের এ সময় মিষ্টি খাবার যেমন- কেক, সিরিয়াল, বাজারজাত জুস, কোমল পানীয়, উচ্চমাত্রার চিনি দিয়ে তৈরি খাবার অসুস্থতার বড় কারণ।
শীতের সময় সব ধরনের ভাজা খাবার খাওয়া খাবেন না। উচ্চমাত্রার ফ্যাট ক্ষতিকর।
শীতে অসুস্থতা এড়াতে হিস্টামিনযুক্ত খাবার এড়াতে হবে। এ ধরনের খাবারের মধ্যে ডিম, মাশরুম, টমেটো, শুকনো ফল, দই উল্লেখযোগ্য। এগুলো বুকে কফ উৎপাদন করে।বুকে কফ জমলে, গলা ব্যথা, সর্দি-কাশি হলে শীতের সময় চিকিৎসকরা দুধ না খাওয়াই ভালো বলে রায় দেন। এ সময় দুধ বুকে কফ জমায়।
বেশি পরিমাণ ফাইবার যুক্ত খাবার খান। আপেল, ওটস এবং বাদাম ফাইবার যুক্ত খাবার। এগুলো শরীরের ওজন এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস করে এবং তার পাশাপাশি ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার, লেবু জাতীয় ফল এবং জিঙ্ক জাতীয় খাবার খান। এই খাবারগুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
শীতের রুপচর্চা
শীতের রুপচর্চা একটু জটিল। শরত থেকেই প্রস্তুতি নিতে হয়। শীত এলেই যা করবেন।
ত্বকের যত্নে: বিভিন্ন রকমের বিউটি ওয়েল বা সৌন্দর্যবর্ধক তেল ব্যবহারে ত্বকে আর্দ্রতার ভারসাম্য থাকে। নারকেল তেলই এক্ষেত্রে সেরা।তেল ব্যবহারে লোমকূপ থেকে ময়লা দূর হয়, দাগ কমে ও উজ্জ্বলতা বাড়ে। বিভিন্ন তেলের পাশাপাশি বেছে নিন ভালো মানের গ্লিসারিন ও ময়শ্চারাইজ সমৃদ্ধ লোশন। শীতে ত্বকের আর্দ্রতা তো ধরে রাখতে হবে। গোসলের পর ও প্রতিবার মুখ ধোয়ার পর ভেজা অবস্থায় ময়েশ্চারাইজার বা লোশন ব্যবহার করুন। গোসলের সময় আরাম অনুভব হলেও শীতে অতিরিক্ত গরম পানি দিয়ে মুখ, মাথা ধোয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
ঠোঁটের যত্ন: ভালো লিপবাম ব্যবহার করুন। ঠোঁটে কোনো শুষ্কতা নয়।
চুলের যত্ন: শীতে চুলের রুক্ষভাব থাকে। সেজন্য তেল নিয়মিত ব্যবহার করুন। খুশকির সমস্যা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে মৌরি ও সমপরিমাণ পানি সারা রাত ভিজিয়ে রেখে পরদিন ভালোমতো বেটে মাথার ত্বকে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাগিয়ে রাখুন। এরপর শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। সময় পেলেই সপ্তাহের যেকেনো দিন চুলে হট অয়েল ট্রিটমেন্ট ও হেয়ার মাস্ক ব্যবহার করতে পারলে ভালো। ঘুমাতে যাওয়ার আগে তেল লাগাবেন অবশ্যই। শীতের সময় চুল ধুতে হবে নিয়মিত। এ সময় বাইরে অনেক বেশি ধুলাবালি উড়ে বলে রোজ চুল পরিষ্কার করা উচিত।
খবর সারাবেলা / ০২ নভেম্বর ২০২৩ / এমএম