আষাঢ়ের রূপবৈচিত্র্য

নূপুর পায়ে রিনিঝিনি শব্দে নৈসর্গিক বাংলাদেশে যে মাসের আগমন ঘটে সে মাস আষাঢ় মাস। বর্ষাঋতুর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় এ মাসের প্রথম দিন থেকে। বাংলা বর্ষপঞ্জির আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসব্যাপী (১৫ জুন থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত) কালপর্ব-ই বর্ষাকাল, যা গ্রীষ্মের পরবর্তী ও শরতের পূর্ববতী ঋতু। আমাদের দেশে আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস যা বর্ষা ঋতুর অন্তর্ভুক্ত দু’মাসের প্রথম মাস।

বাংলাদেশে অপরাপর মাসের মতো আষাঢ়ের নাম প্রদানও হয়েছে নক্ষত্রের নামে। বইপত্রাদি পাঠে জানা যায়, নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্র ও উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। অথৈ পানি তার বৈভব। আষাঢ়ের অথৈ পানি, বাদলদিনে ফোটা কদম ফুলসহ পাহাড়-নদী-বন প্রভৃতির সমন্বয়ে সৃষ্ট প্রকৃতির চেতনা প্রতিটি প্রকৃতি প্রেমিক মনকেই আন্দোলিত করে। কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী-চিত্রশিল্পীর বেলায় তো এর আবেদন আরো বেশি। এ সময়ে আরো ফোটে শাপলা, পদ্ম, চালতা, কেতকী ফুল যা মানব মনকে যথার্থই রোমাঞ্চিত করে।

দেশীয় কবি লেখকগণ বিভিন্ন সময়ে বর্ষার প্রথম মাস আষাঢ়কে নারীর রূপকল্পে চিত্রিত করেছেন। বর্ষা ঋতুকে কবিতা-ছড়ায়, গল্প-নাটকে, কিংবা উপন্যাসে স্থান দেননি এমন লেখক বাংলাসাহিত্যে খুব কম-ই আছেন। খ্যাতিমান কবি শেখর কালিদাস বর্ষা নিয়ে অনেক পদ্য-কবিতা লিখেছেন। বাংলাসাহিত্যে ‘ছন্দের জাদুকর’ সংজ্ঞাপ্রাপ্ত কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের বর্ষা নিয়ে রচিত কবিতা বর্ষা, ইলশে গুঁড়ি ও বর্ষা নিমন্ত্রণ পাঠকের মনকে এখনো নাড়া দেয়।

অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষাপ্রণয় তো যথারীতি উপদেশসংবলিত উক্তিতুল্য। তাছাড়া আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লী কবি জসীমউদ্দীন প্রমুখ কবিগণ বর্ষাকে তাদের সৃষ্টিশীল কাজে উত্থাপন করেছেন নানারকম শিল্পনৈপুণ্যে। চিত্রকররা বর্ষাকে ক্যাম্বিসে আঁকতে খুব পছন্দ করেন। দৃষ্টান্তরূপে বিবৃত, স্বনামখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের ‘বৃষ্টির দিনে খেয়া ঘাট’ শিরোনামবিশিষ্ট চিত্রশিল্পটি আজও অদ্বিতীয়। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা, মধুমাস খ্যাত জ্যৈষ্ঠ মাসের সুস্বাদু ফলের সমাহার এ মাসে এসেও লক্ষণীয়। তার মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু আনারস, লুকলুকি, ভুবি, জামরুল উল্লেখ্য।

আষাঢ় ছাড়াও আষাঢ় মাসের আরেকটি নাম যজ্ঞের মাস। আমাদের দেশে ন্যূনাধিক সকলেই বিদিত যে, ‘বারো মাসে তেরো পূজা’ উদযাপনকারীদের নিকট এ মাস অনেক শ্রদ্ধার। এ মাসেই আমাদের দেশসহ পুরো ভারতে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা রথযাত্রা যজ্ঞ পালন করে থাকে। রথযাত্রা যজ্ঞ উপলক্ষে ভারতের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছর জেলা উপজেলায় মেলা বসে। দেশে মেলা মানেই বারোয়ারি পরমানন্দ। বাংলাদেশে রথযাত্রা উপলক্ষে সবচে’ বেশি মেলা বসে ময়মনসিংহ জেলায়। এছাড়া সুনামগঞ্জ, জামালপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, পাবনা, যশোর, রাজশাহী, ফরিদপুর জেলা উল্লেখ্য।

তবে ঢাকা বিভাগের ধামরাই ও মানিকগঞ্জের রথযাত্রা যজ্ঞের সুনাম সমগ্র দেশে পরিব্যাপ্ত। বর্ষা ঋতু আমাদের জন্য ক্ষতিকারক না লাভজনক এ নিয়ে মানবমনে আছে নানা প্রশ্ন। বর্ষার অথৈ জলপ্রবাহ সাধারণ মানুষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করলেও প্রকৃতিকে করে দেয় ফুরফুরে মেজাজের। বন্যার বা নদীপ্রবাহের ঘোলা জল থেকে থিতিয়ে-পড়া নরম মাটির স্তর বা প্রলেপ অর্থাৎ পলিমাটি এসে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা হিসেবে আমাদের দেশকে প্রতিবছর নতুনভাবে নির্মাণ করে বর্ষা ঋতুই। এদিক থেকে বর্ষা ঋতু আমাদের জন্য এক মহাআশীর্বাদ। তবে দেশীয় পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ুগত পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত ক্ষণস্থায়ী কিংবা প্রলম্বিত হচ্ছে। লোকশ্রুতি আছে, বর্ষা ‘কারো জন্য পৌষ মাস, কারো জন্য সর্বনাশ’।

বাংলাদেশে হিন্দুধর্মাবলম্বী সূত্রধর যারা আছে তাদের অধিকাংশই কাঠের মিস্ত্রি। যাদের আরেক নাম ছুতোর। ছুতোর সম্প্রদায় এ সময় নৌকা বানাতে খুব ব্যস্ত থাকে। রাতদিন কাজ করে তারা বিভিন্ন আকৃতির কাঠের নৌকা বানায়। তারমধ্যে গলুই ওয়ালা নৌকা, কোষা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা উল্লেখ্য। আষাঢ়ের নতুন পানিতে গ্রামাঞ্চলে মৎস্যজীবীসহ সাধারণ মানুষজন প্রতিদিন মাছ শিকারে বের হয়। এমনকি বৃষ্টিহীন রাতের বেলা মাছ শিকারের নিমিত্তে ধনী গৃহস্থ লোকও নৌকাযোগে আলউয়ারা দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।

আলউয়ারাতে গ্রামের লোকজন ছোট-বড় নানা প্রজাতির মাছ শিকার করে থাকে। এসময় চাঁদনি কিংবা আঁধার রাতে চারদিক থেকে ব্যাঙের ডাক ‘ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ, ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ’ ভেসে আসে। রাতের বেলা ব্যাঙের এই ডাক অনেক শ্রুতিমধুর। এসময় আষাঢ়কে মনে হয় সংগীত ও স্বপ্নের রাজ্য। ভাবুক মনকে নিয়ে যায় অন্য এক জগতে। বাংলাদেশের মানুষজন প্রতি বছর এভাবেই আষাঢ় মাসে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে বর্ষাকে বরণ করে নেয়।

খবর সারাবেলা / ০৪ জুলাই ২০২০ / এমএম