মায়া
এই অসময়ে আবার বৃষ্টি শুরু হলো। দুদিন হলো জামিলের গায়ে জ্বর। কাশিও আছে বেশ। রূপা বাসায় নেই। বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাড়লে ও খুব রাগ করবে। এই শ্যামলা মেয়েটাকে নিয়ে হয়েছে যন্ত্রণা। চোখের কোথায় যেন হাসি লেগেই থাকে। মন খারাপ হলেই বিপদ। বড় বড় চোখ করে শুধু তাকিয়ে থাকে। হাজারটা প্রশ্ন করলেও উত্তর দেয় না। মহা যন্ত্রণা। এর থেকে চিত্কার করে ঝগড়া করলেও ভালো হতো।
সন্ধ্যার এই সময়ে মফস্সল শহরের রাস্তায় বেশ ভিড় থাকে। দিন শেষে সবাই আড্ডা দিতে আসে। রাজনীতি নিয়ে বেশ গল্পগুজব হয়। আজ আবহাওয়া ভালো না। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা। বৃষ্টির লক্ষণ ভালো না। এই ধরনের বৃষ্টি সাধারণত লম্বা সময়েও ছাড়তে চায় না। অপেক্ষা করাটা মনে হয় বোকামি হবে। জামিল হাঁটতে থাকে। বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বৃষ্টিতে হাঁটা বেশ কষ্টের। রাস্তায় জায়গায় জায়গায় কাদাপানি জমে আছে। রিকশা পেলে ভালো হতো।
‘স্যার আসসালামু আলাইকুম।’ জামিল মাথা ঝাঁকায়। ক্লাস সেভেনের ছাত্র মিনহাজের বাবা। ভদ্রলোক ঠিকাদারি করেন। বেশ টাকাপয়সা আছে মনে হয়।
‘স্যার ভাবি কি এসেছেন?’ খুবই বিব্রতকর প্রশ্ন। এই প্রশ্নটা ইদানীং মাঝেমাঝেই শুনতে হয়। ‘ভাবি’র প্রতি এদের আগ্রহের কারণটা জামিল ঠিক ধরতে পারে না। জামিল উত্তর না দিয়েই হাঁটতে থাকে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি আরো জোরে আসবে।
রূপা ঢাকায় থাকতে চায় না। ঢাকায় নাকি দম বন্ধ হয়ে আসে। জামিল এখানে একটা স্কুলে পড়ায়। সিনিয়র শিক্ষক। রূপা সব সময় চেয়েছে জামিল মফস্সলের কোনো স্কুলে পড়াবে। থাকবে টিনের ঘরে। কী আজব মেয়ে। এই যুগে কেউ এমন কিছু চাইতে পারে কল্পনাও করা যায় না। প্রথম প্রথম জামিল অবাক হতো। এখন হয় না।
জামিল কাকভেজা হয়ে ঘরে ফেরে। হাতে বাজারের ব্যাগ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। তাড়াতাড়ি গা মুছে ফেলা দরকার। জামিলের আবার অল্পতেই ঠান্ডা লাগার ধাত। জ্বরের মধ্যে নতুন করে ঠান্ডা লাগলে ঝামেলা হয়ে যাবে। আলনায় ভাঁজ করা গামছা। রূপা যেন জানত জামিল আজ বৃষ্টিতে ভিজে বাসায় আসবে। রূপা খুব গোছানো। এমনভাবে জিনিসপত্র রাখে যাতে হাতের কাছে সব পাওয়া যায়। জামিল দ্রুত মাথা মুছতে থাকে। রান্নার আয়োজন করা দরকার।
প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। নাইনের বিজ্ঞান ক্লাস শেষে চেয়ারে বসে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে বুঝতে পারেনি। রঞ্জিত স্যার ডেকে তুলেছেন।
‘জামিল, তোমার তো দেখি অবস্হা টাইট। গায়ে বেশ জ্বর। ডাক্তার দেখানো দরকার।’
‘স্যার আমি ঠিক আছি।’ রঞ্জিত স্যার ভ্রু কোঁচকান। জামিল ক্লাসের দিকে হাঁটতে থাকে।
জামিল রান্না চড়ায়। রাঁধুনি হিসেবে নিজেকে দশে আট দেয় জামিল। রূপার মতে ওর দশে নয় পাওয়া উচিত। দশে দশই পেত। শুধু মুরগির মাংস আর হাঁসের মাংস রান্না করলে স্বাদ প্রায় একইরকম হয়ে যায়। বারান্দায় ছোট একটা কেরোসিন চুলায় রান্না বসানো হয়েছে। খিচুড়ি রান্না হবে। সবজি খিচুড়ি। টিনের চালে ঝুমবৃষ্টির শব্দ। বাতাসে বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে। জামিলের গায়ে চাদর। তবুও বেশ ঠান্ডা লাগছে। রূপা থাকলে ভালো হতো। একটা গান শোনা যেত। রূপার গানের গলা বেশ ভালো। বেশ মায়া নিয়ে গায়।
জামিল হঠাত্ খেয়াল করে ঘরে রূপার কোনো ছবি নেই। ফোনেও নেই। একটা ছবি রাখা উচিত ছিল। এবার এলে কয়েকটা ছবি তুলতে হবে। ফোন বাজছে। বৃষ্টির শব্দে জামিল বুঝতেই পারেনি।
‘হ্যালো’ ওপাশে ভারী কণ্ঠ। নুরুল আলম সাহেব। রূপার বাবা।
‘বাবা স্লামালাইকুম।’
‘জামিল কেমন আছ?’
‘জি ভালো’
‘আমি কুষ্টিয়ায়। তুমি বাসায় আছ?’
‘জি বাবা।’
‘তোমার গলা এমন লাগছে কেন। তোমার শরীর কি বেশি খারাপ?’
‘জি না। খারাপ না।’
‘আমি অনেকবার বলেছি আমাকে বাবা না ডাকতে।’ জামিল চুপ করে থাকে।
‘অনেকদিন হয়ে গেছে। তুমি ঢাকায় ফেরো। বাবা-মায়ের কথাও তো ভাবা উচিত।’
‘কথা বলছ না কেন?’
জামিল ফোন কেটে দেয়। রঞ্জিত স্যার কল করেছিলেন কয়েকবার। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। চুলার পাশে বসে জামিল বৃষ্টি দেখতে থাকে। জামিলের জ্বর বেড়েছে। কোথা থেকে যেন চুড়ির শব্দ আসছে। খারাপ লক্ষণ। রূপা বাসায় নেই। চুড়ির শব্দ আসার কোনো কারণ নেই। জামিল কি ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে?
রাত প্রায় শেষের দিকে। অনেক কষ্টে একটা মাইক্রোবাস আনা হয়েছে। জামিলকে ঢাকায় নেওয়া হবে। চারিদিক কাদাপানি হয়ে আছে। রঞ্জিত স্যার বিরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। রূপার বাবা নুরুল আলম এসেছেন। উনার বিষয়টা রঞ্জিত স্যার পরিষ্কার হতে পারছেন না। এই লোক এখানে কীভাবে এলো? উনার জন্য দেরি হচ্ছে। জামিলকে দ্রুত ঢাকায় নেওয়া দরকার। রঞ্জিত স্যার বিরক্ত মুখে এগিয়ে যান।
‘দেরি হচ্ছে। রওনা করা দরকার।’
‘জি অবশ্যই।’
‘ভাই আপনার মেয়ে কই? এত বছরে কখনোই দেখলাম না। জামাইকে এভাবে কেউ একা রেখে দেয়?’
নুরুল আলম চুপ করে থাকেন। বেশ অপ্রস্ত্তত হয়ে গেছেন।
‘স্যার, আমার মেয়ে নয় বছর আগে মারা গেছে।’ রূপার বাবা নুরুল আলমের গলা কেঁপে ওঠে।
মেঘ ডাকছে বেশ জোরে। রঞ্জিত স্যার হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। সবকিছু এলোমেলো লাগছে তার। বেশ গতিতে মাইক্রোবাস ছুটে চলছে। জামিলকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে। সঙ্গে নেওয়া ডাক্তার বেশ চিন্িতত ভঙ্গিতে বসে আছেন। ডাক্তারের ধারণা জামিলের নিউমোনিয়া বেশ জটিল আকার ধারণ করেছে। মাইক্রোর সামনের সিটে রঞ্জিত স্যার বসা। নুরুল আলম জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখছেন।
জামিল আধো আলোয় সবাইকে আবছা দেখতে পাচ্ছে। বৃষ্টির শব্দ আসছে কানে। মাথার চুলে কি কেউ হাত বোলাচ্ছে? চুড়ির আওয়াজ আসছে। রূপা মনে হয় আজ নীল চুড়ি পরেছে। আওয়াজ শুনে জামিল কীভাবে যেন রূপার চুড়ির রং বলে দিতে পারে। খুব পরিচিত একটা গানের সুর কানে আসছে। গানের কথাগুলো কিছুতেই মনে আসছে না। জামিল চোখ বন্ধ করে। খুব ঘুম পাচ্ছে।
খবর সারাবেলা / ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ / এমএম